নিশ্চয়ই আপনারা একমত হবেন যে, ধীরে ধীরে দেশে স্বাস্থ্যসচেতন মানুষের সংখ্যা বাড়ছে…! কোন দাওয়াতে গিয়ে গামলা ভর্তি করে তেল চপচপে খাবার সাবাড় করে বড়াই করা এমন কি চায়ে ৩-৪ চামচ চিনি খাওয়ার মত কাজগুলো মানুষ এখন অনেকটাই এড়িয়ে চলছেন, তাই না? আর এক্সারসাইজ , যা কিনা আগে ছিল শুধুই উচ্চশ্রেণীর ‘শখ’ এখন যুগের প্রয়োজনে সবাই এই অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজটিকে শখের/ টাইম পাসের সেলফ থেকে নামিয়ে এনে নিজের ডেইলি রুটিনে ফিট করার চেষ্টা করছেন।
সাথে সাথেই বেড়ে গেছে এক ধণের হেলথ ফুডের বাজার। অনেকেই আছেন অনেক চেষ্টা করে ব্যাড হ্যাবিট ছাড়তে পাড়ছেন না। এসব হেলথ ফুডের চক্করে তারাই পড়ছেন। না, আমি বলছি না হেলথ ফুড ছেড়ে দেবেন! কেউ তো আর একদিনে চিনি খাওয়া বাদ দিতে পারে না!! অথবা সাদা ভাত ছেড়ে দিতে পারে না!! মাঝখানে নির্দিষ্ট ট্রান্সিশন পিরিয়ড তো সবার দরকার হয়!!
কিন্তু আপনি কী ভাবছেন? চিনি খাওয়া ছাড়বেন! কিন্তু মিষ্টি খেতে ভালো লাগে… তাহলে হয়ত সারাজীবন ডায়েট কোক খেতে পারবেন? অথবা বাজারে সহজে পাওয়া যায় এমন সুগার সাবসটিটিউট একনাগাড়ে খেয়ে যেতে পারবেন? তবে আপনার জন্য কিছু ইনফরমেশন! অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া বাদ দিয়েছেন, বেশ ভালো কথা… কিন্তু পর্যাপ্ত জ্ঞানের অভাবে স্বাস্থ্যকর খাবার নামক কিছু প্রোডাক্টের ফাঁদে পা দিয়ে নিজের দেহের সর্বনাশ করছেন না তো??
১। সুগার ফ্রি ফুড/ সুগার সাবস্টিটিউট
হেলথ ফুডের মধ্যে এটাই সবচেয়ে প্রচলিত। সবাই জানে চিনি খাওয়া স্বাস্থ্য এবং সৌন্দর্যের জন্য কতটা খারাপ… আর যারা ওজন কমানোর প্রসেসের মধ্যে আছেন তাদের তো সবার আগে চিনিটাই বাদ দিতে হবে। কিন্তু কিছু চিনি বিহীন খাবারের অ্যাড দেখে সবাই ভাবেন, যাকগে এখন থেকে চিনির বদলে এটাই খাব। মিষ্টিটা তো খেতে পারব অ্যাটলিস্ট!! সুতরাং শুধুমাত্র স্বাদের জন্য তারা পড়ে যান সুগার ফ্রি খাবারের চক্করে।
আমাদের দেশে যেসব সুগার সাবসটিটিউট ইউজ করা হয়, তার মধ্যে কিছু হচ্ছে-
স্যাকারিন, আস্পারটেম, সুক্রালজ ইত্ত্যাদি। বিভিন্ন দোকানের সুগার ফ্রি মিষ্টিগুলোতেও এগুলোই ব্যবহার করা হয়। কিন্তু, আপনি কি সিওর যে এগুলোর কোন সাইড ইফেক্ট নেই? সারাজীবন চিনির বদলে এগুলো খাওয়া যাবে কি না জানেন? এই কেমিক্যালগুলোর দীর্ঘমেয়াদি ব্যাবহারে মাথাব্যাথা, পেটে সমস্যা এবং কিডনি ফেইলিওর, ব্রেন টিউমার পর্যন্ত হতে পারে। তাহলে চিন্তা করুন, অস্বাস্থ্যকর চিনির বদলে নিজের জন্য অথবা নিজের প্রিয়জনের জন্য আরও ভয়াবহ কিছু বেছে নিচ্ছেন নাতো??
২। ডায়েট কোল্ড ড্রিঙ্ক
কমবয়সী স্বাস্থ্য সচেতন ছেলে মেয়েদের মধ্যে খুবই পপুলার। তারা মনে করে কোল্ড ড্রিঙ্কের এত এত ক্যালরিকে একটা ডায়েট ড্রিঙ্ক দিয়েই কাটিয়ে দেয়া যায়।!!! এটা আসলে ফলস মেনটাল স্যাটিসফ্যাকশন ছাড়া আর কিছুই না।
কারণ?? এক নম্বর পয়েন্টটা আবার পড়ুন। ডায়েট ড্রিঙ্কে সবসময় ই আর্টিফিশিয়াল সুইটেনার ইউজ করা হয়। সেদিক থেকে চিন্তা করলে, নরমাল ড্রিঙ্কের চেয়ে বেশি টাকা দিয়ে হেলথ রিস্কে পড়ার চাইতে আমি বরং ব্যাক্তিগত ভাবে নরমাল চিনিযুক্ত অস্বাস্থ্যকর কোল্ড ড্রিঙ্কটাই বরং পরিমিত হারে খাওয়াকে ভালো আইডিয়া বলে মনে করব…
৩। ফ্যাট ফ্রি খাবার
পেজে কোন ডায়েট চার্ট শেয়ার করা হলে অনেকেই দেখি বলেন-
কোন কাজ হয় না!! আমি এর চেয়ে অনেক কম খাই, ওজন কমে না!!!
কিন্তু আমি যদি বলি, কম খাওয়ার জন্যই আপনার ওজন কমছে না?? তবে? অনেকেই আছেন বেশি স্বাস্থ্যসচেতনতা এবং কম জ্ঞানের কারণে খাবারের লিস্ট ছোট করতে করতে শরীরের বেসিক দরকারি পুষ্টিটুকু পর্যন্ত বাদ দিয়ে দেন। এমনি একটি খাবার হল ‘ফ্যাট’!!!
চর্বি খেলে মোটা হয়, এই কনসেপ্ট থেকে খাবারের তালিকা থেকে পুরোপুরি ফ্যাট বাদ দেয়ার ফলে কী কী সমস্যা হয়?
- স্কিন রাফ হয়ে যায়। আমাদের স্কিনের সৌন্দর্য বজায় রাখার জন্য ফ্যাট অত্যন্ত গুরুত্তপূর্ণ!! খেয়াল করেছেন কেউ হঠাৎ ক্রাশ ডায়েট করলে স্কিন কতো খারাপ হয়ে যায়?? অথচ সে কিন্তু ডায়েটে তথাকথিত হেলথ ফুড। ভেজিটেবল, ফলের কোন কমতি রাখে না!!
- শরীরের মেটাবলিসম কমে যায়, মানে শরীর তখন দরকারি ফ্যাটের অভাবে সব খাবারই না পুড়িয়ে ফ্যাটে বদলে ফেলে দরকারি পুষ্টি সঞ্চয় করার চেষ্টা করে। ফলাফল? আপনি খাওয়া কমাতে কমাতে প্রায় ছেড়ে দিলেও আপনার ওজন কমে না!!
- বিভিন্ন খাবার হজম হওয়ার জন্য দরকার নুন্যতম ফ্যাট। একারণে স্কিমড মিল্ক/ ননি বিহীন দুধ খুবই খারাপ খাবার। কারণ এতে দুধ হজম হবার মত দরকারি ফ্যাট না থাকায় অনেকেই হজমের সমস্যায় ভোগেন।
- ফ্যাট থেকে আমরা পাই প্রচুর দরকারি ভিটামিন এমং খনিজ, যেগুলোর অভাবে দেহ ধীরে ধীরে তার কর্মক্ষমতা হারায়।
- সবচেয়ে ভয়াবহ ফ্যাক্ট , ম্যাক্সিমাম ক্ষেত্রে ফ্যাট ফ্রি খাবারগুলো হয় বিস্বাদ, সুতরাং খাবারের স্বাদ এবং বিক্রি দুটোই বাড়াতে বিক্রেতারা এতে অ্যাড করেন অতিরিক্ত লবন, এবং আর্টিফিশিয়াল স্বাদ বর্ধক। যা আমাদের দেহে ওয়াটার রিটেশন, হার্টের প্রব্লেম, কিডনি সমস্যা, এবং ব্লাড প্রেসারে ইরেগুলারিটি আনার জন্য যথেষ্ট।
সুতরাং, পরিমিত খাওয়ার হ্যাবিট গড়ে না তুলে , দরকারি পুষ্টি বাদ দেয়ায় অথবা ফ্যাট ফ্রি শর্টকাট নেয়ার মতলবটা কিন্তু খুব একটা বুদ্ধিমানের কাজ নয় বুঝাতেই পারছেন।
৩। ব্রেকফাস্ট সিরিয়াল
সিরিয়াসলি, আপনি কি মনে করেন? কোন ডায়েট, এক্সারসাইজ ছাড়া নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের একটি সিরিয়াল খেয়ে আপনার ওজন কমিয়ে আপনি পুরোপুরি ফিট এবং হেলথি হয়ে যাবেন??
ব্রেকফাস্ট সিরিয়াল খাওয়া খারাপ কিছু না। নরমাল ময়দার রুটির বদলে সিরিয়ালকে স্বাস্থ্যকর ভাবাটা হচ্ছে খারাপ। কারণ সত্যি এতে এমন কিছুই নেই যা ময়দার রুটিতে নেই। কিন্তু এটাকে টেস্টি বানানর জন্য এতে নানা কেমিক্যাল অ্যাড করা হতে পারে, সাথে থাকতে পারে আর্টিফিশিয়াল ফ্লেভার এজেন্ট। অনেকে আবার অল্পখেয়ে ক্ষুধা মেটাতে না পেড়ে পরিমানে এত বেশি খান, যে ৪-৫টা রুটির সমান ক্যালোরি সিরিয়াল থেকে খেয়ে নেন। যেখানে সে হয়ত ২ টা রুটি খেতেন!!!
তাহলে এই হেলথ ফুড খেয়ে আপনার কী উপকার হল? এর চাইতে বরং সাদা ময়দা অথবা আটার রুটির বদলে পরিমিতও লাল আটার রুটি খান। একি সাথে পুষ্টিও পাবেন এবং ভালো স্বাস্থ্যও…
মনে রাখবেন, অতিরিক্ত ওজন কমান যদি শুধু একটা নির্দিষ্ট খাবার খেয়ে/ চা খেয়ে সম্ভব হত তবে সারা দুনিয়ার মানুষ এক্সারসাইজ ছেড়ে দিত!!! তাই না!! কমন সেন্স তো তাই বলে… তাহলে দুনিয়ার বিখ্যাত অভিনেতা অভিনেত্রীরাও এসব চা, স্লিমিং ফুড না খেয়ে দিন রাত এক্সারসাইজ করে হেলথ ঠিক রাখে কেন??
এতুকু চিন্তা করলেই অনেক বড় হেলথ রিস্ক থেকে আপনারা বেঁচে যেতে পারবেন কিন্তু…
আশা করি ভবিষ্যতে ডায়েট আর হেলথের চিন্তায় তথাকথিত হেলথ ফুডের পাল্লায় পড়ার আগে আরেকবার ভেবে দেখবেন!! পরিমিতও খাওয়া আর এক্সারসাইজের কোন বিকল্প নেই।
লিখেছেন – তাবাসসুম মুস্তারি মীম
ছবি – হেলথটুডে.কম