রান্নাঘরে যাদের আসা-যাওয়া আছে, তারা বেকিং সোডার সাথে পরিচয় থাকার কথা। বেকিং সোডা যাকে আমরা সাধারণত খাবার সোডা বলে থাকি । রসায়নে এই যৌগটির নাম সোডিয়াম বাইকার্বনেট, রাসয়নিক সংকেত NaHCO3। এটি ইউরোপীয় ইউনিয়ন একে খাদ্য উপাদান বলে স্বীকৃতি ও দিয়েছে। বিভিন্নভাবে ব্যবহৃত হওয়ায় এটি বিভিন্ন নামে পরিচিত, যেমন- বেকিং সোডা, ব্রেড সোডা, কুকিং সোডা, বাইকার্বনেট অব সোডা ইত্যাদি। তবে বেকিং সোডা কি শুধু রান্নাঘরেই সীমাবদ্ধ আছে? যারা নিয়মিত দেশি বিদেশি লাইফস্টাইল ম্যাগাজিন ফলো করেন তারাও হয়তো জেনে থাকবেন এই পণ্যটি বিভিন্ন DIY এ ব্যবহার করা হয়। আজকে আমরা আলোচনা করব বেকিং সোডার বিভিন্ন ব্যবহার সম্পর্কে, বিশেষ করে রূপচর্চায়। তো শুরু করা যাক……
(১) মুখের স্ক্রাব হিসেবে
বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমাদের ত্বকের নতুন কোষ তৈরি করার ক্ষমতা ও কমতে থাকে। ফলে ত্বকের উপর মৃতকোষগুলো জমতে থাকে। নিয়মিত সেটি না সরালে আপনার ত্বক হয়ে পড়ে আরো নিষ্প্রাণ আর ত্বকের গুনাগুন ও নষ্ট হয় যা আপনাকে দ্রুত বয়স্ক করে তোলে । এই মৃতকোষগুলোকে সরাতে চাই নিয়মিত স্ক্রাবিং। আর এই স্ক্রাবিং এ আপনার সবচেয়ে ভালো বন্ধু হতে পারে বেকিং সোডা। বাজারে ও স্ক্রাবিং পণ্য পাওয়া যায়, কিন্ত ভালো স্ক্রাবারের জন্য আপনাকে গুনতে হবে অনেকগুলো টাকা। অথচ সুলভ বেকিং সোডা আপনার ঐসব দামি পন্যগুলো থেকে আরো ভালো ফলাফল দিতে পারে।
আপনার রেগুলার ফেসওয়াশের সাথে সামান্য পরিমাণ বেকিং সোডা নিন। হাতের তালুতে ভালো করে মিশিয়ে ভেজা মুখে লাগিয়ে আস্তে আস্তে উপরের দিকে আঙ্গুল ঘুরিয়ে ম্যাসাজ করতে থাকুন। বেকিং সোডার ছোট ছোট দানাগুলো আপনার ত্বকের উপরের মৃতকোষগুলোকে নরম করে তুলে ফেলবে। ৩/৪ মিনিট ম্যাসাজ করে প্রথমে কুসুম গরম পানি দিয়ে এবং পরে ঠান্ডা পানি দিয়ে ভালো করে মুখ ধুয়ে নিন। মুখ ধোয়ার সাথে সাথে আপনি আপনার নরম, মসৃণ ত্বক অনুভব করতে পারবেন।
(২) দূর করুন ব্ল্যাকহেডস/হোয়াইটহেডস
ব্ল্যাকহেডস আর হোয়াইটহেডস আজকাল খুব সাধারণ সমস্যা হয়ে দাড়িয়ছে। খুঁজতে গেলে খুব কম মানুষ পাওয়া যাবে যারা এই সমস্যা থেকে মুক্ত। যাদের স্কিন তৈলাক্ত তারা সবচেয়ে বেশি এই সমস্যায় ভোগেন। তৈলাক্ত ত্বকের লোমকোপগুলো বড়/দৃশ্যমান হয়ে থাকে । ফলে সহজেই ধুলো ময়লা আটকে যায় লোমকূপে। এটিকে তখন বলা হয় হোয়াইটহেডস। পরে যা বাতাসের সাথে অক্সিডাইজ হয়ে কালো হয়ে ব্ল্যাকহেডস সৃষ্টি করে। অাবার অনেকগুলো ব্ল্যাকহেডস জমে মুখে নতুন তিল তৈরি করে। ফলে নাকের চারপাশ থেকে শুরু করে সারা মুখে তিল সৃষ্টি হতে থাকে যা চেহারার সৌন্দর্য নষ্ট করে দেয়। তাই সময়মত ব্ল্যাকহেডসগুলোকে সরাতে না পারলে তৈরি হোন কালচে দাগযুক্ত ত্বককে বরণ করে নেওয়ার জন্য।
এবার আসি প্রতিকারে। কীভাবে দূর করবেন এই শত্রুকে? খুব সহজ! বাজারে ব্ল্যাকহেডস দূর করার জন্য নানান প্রোডাক্ট পাওয়া যায়, কিন্তু তাদের বিজ্ঞাপনের ১০০% কার্যকারিতার প্রমাণ মিলেনি কোনোদিন। তাই বাড়িতেই তৈরি করে নিন ব্ল্যাকহেড রিমুভার।
যা যা লাগবে -
- বেকিং সোডা – ১ টেবিল চামচ
- মধু -২ টেবিল চামচ
এই দুটো উপকরণ একসাথে ভালো করে মিশিয়ে নিন। এবার আপনার সারা মুখে এই মাস্কটি আঙ্গুলের সাহায্যে লাগিয়ে নিন। কিছু সময় অপেক্ষা করুন, যতক্ষন না মাস্কটি পুরোপুরি শুকিয়ে যায়। শুকিয়ে গেলে হালকা গরম পানিতে একটি সুতির কাপড়/রুমাল ভিজিয়ে একটু চিপে বের করে দিন। এবার সেটি মুখের উপর রেখে আস্তে আস্তে চাপ দিন যাতে শুকনো মাস্কটি নরম হয়। এবার ভেজা হাতে আঙ্গুল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ম্যাসাজ করে মুখ ধুয়ে নিন। এরপর রেগুলার টোনার, ময়েশ্চারাইজার লাগিয়ে নিন। সপ্তাহে দু বার ব্যবহার করতে পারেন এই মাস্ক। প্রথম ব্যবহারেই আপনি পার্থক্যটা বুঝতে পারবেন। ব্যবহারের আগে মুখের স্কিনের ছবি তুলে রাখুন এবং প্রত্যেকবার এই মাস্ক ব্যবহার করার পর প্রথম ছবির সাথে তুলনা করুন। এতে করে মাস্কটি আপনার স্কিনে কাজ করছে কিনা প্রমাণিত হবে।
(৩) হোমমেইড ডিপ ক্লিনজিং শ্যাম্পু
আমরা চুল পরিস্কার রাখতে বাজারের সেরা শ্যাম্পু বেছে নিই। যদি আপনার চুল এমনিতেই স্বাস্থবান আর সিল্কি হয় তাহলে যেকোনো শ্যাম্পু আপনি বেছে নিতে পারেন। কিন্তু যদি আপনার চুল হয় শুষ্ক, ড্যামেজড, রুক্ষ তাহলে বাজারের সেরা শ্যাম্পুগুলোই হয় আপনার শত্রু। আজকাল ন্যাচারালি সিল্কি চুলের অধিকারি মানুষের সংখ্যা হাতেগোনা। তাই আমরা যারা ড্যামেজড চুলের অধিকারি, আমাদের বেছে নিতে হবে এমন শ্যাম্পু যা আমাদের চুলের ক্ষতিটা কম করে।
তো কেমন হবে আমাদের শ্যাম্পু? ” Sodium Laureth Sulphate ” এই নামটি খুজুন আপনার শ্যাম্পুর উপাদানের তালিকায়। এই রাসায়নিক পদার্থটি আমাদের কাপড় কাচার ডিটারজেন্ট সাবানের মূল উপাদান। এটির কাজ ফেনা তোলা আর পরিস্কার করা। একবার ভেবে দেখুন যে পদার্থটি আপনার কাপড় পরিস্কার করছে সেটিই আবার আপনার চুলে ব্যবহার করছেন আপনি!! তাই শ্যাম্পু আপনার চুল পরিস্কার করে ঠিকই, কিন্তু আপনার চুলের আর্দ্রতা ও চুরি করে নেয়। তাই আপনার চুল হয় আরো রুক্ষ।
এখনকার হেয়ার স্টাইলিস্টরা এমন ড্যামেজড চুলের জন্য সাজেস্ট করেন ” No Poo Method” এবং এটি বর্তমানে বেশ জনপ্রিয় পদ্ধতি চুলের ক্ষতি না করে চুল পরিস্কার করার জন্য। “No Poo Method” মূল উপাদান হলো বেকিং সোডা আর যেকোনো ডিপ কন্ডিশনার।
কীভাবে করবেন? প্রথমে একটি মগে ৩/৪ কাপ পানি নিয়ে তাতে ৩ টেবিল চামচ বেকিং সোডা ভালো করে মিশিয়ে নিন। এবার চুল ভিজিয়ে মাথার তালুতে একটু একটু করে মগের দ্রবনটি ঢেলে ম্যাসাজ করতে থাকুন। শুধু মাথার তালুতে। চুলের আগায় ঘষামাজা করার দরকার নেই। তালু থেকে আসা পানিতেই চুলের আগা পরিষ্কার হয়ে যাবে। আমাদের চুলের আগার অংশটি গোড়া থেকে দুর্বল, তাই এতে বেশি ঘষামাজা করলে চুল আরো ড্যামেজড হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আর ময়লা সাধারনত জমে মাথার তালুতে, সেখানে মনোযোগ দিন। এবার পানি দিয়ে চুল ধুয়ে নিন। হালকা চিপে আগার পানি বের করে দিন। এখন যেকোনো ডিপ কন্ডিশনার নিয়ে গোড়ার তিন ইঞ্চি চুল রেখে বাকি চুলে ভালো করে লাগিয়ে ২-৪ মিনিট রেখে দিন। এরপর ধুয়ে ফেলুন।
এই পদ্ধতিতে সপ্তাহে সর্বোচ্চ দু’বার চুল পরিষ্কার করতে পারবেন। এই পদ্ধতি পরীক্ষিত এবং চুলের জন্য নিরাপদ। চুলে ক্যামিক্যালের ব্যবহার যত কমাবেন চুলের গ্রোথ আরো ভালো হবে। No Poo Method দিয়ে শুরু করুন এই যাত্রা।
এখানেই শেষ নয়, আরো অনেকভাবে ব্যবহার করতে পারবেন বেকিং সোডা
- অনেক সময় পানির কারণে / জেনেটিক্যালি আমাদের দাত হলদেটে হয়ে যায়। টুথপেস্টের সাথে সামান্য বেকিং সোডা নিয়ে ব্রাশ করুন নিয়মিত। ভালো ফল পাবেন।
- মেনিকওর/পেডিকিওর করার সময় স্ক্রাবার হিসেবে বেকিং সোডা অতুলনীয়। নখের খসখসানি কমাতেও এটি কার্যকর।
- যেকোন কীটপতঙ্গ বা মৌমাছি কামড় দিলে আক্রান্ত স্থানে বেকিং সোডা লাগিয়ে রাখলে আরাম পাবেন।
- বারবার ব্যবহার করলে মেকআপ ব্রাশগুলো নোংরা হয়ে যায়। পরিস্কার করার প্রয়োজন দেখা দেয়। এক মগ পানিতে ৪ টেবিল চামচ সোডা মিশিয়ে ঐ দ্রবণে ব্রাশগুলো ২০ মিনিট ভিজিয়ে রাখুন। ব্রাশের তেল, ময়লা সব পরিস্কাব হয়ে যাবে।
দেখলেন তো! রান্নাঘরের এই সহজলভ্য উপকরণটি রূপচর্চায় কত উপকারি। আমাদের রান্নাঘরের এমন অনেক জিনিস আছে যা আমরা অনেকভাবে ব্যবহার করতে পারি। তবে তা করতে হবে বুঝে শুনে না হলে হিতে বিপরীত হতে পারে। আরেকটি কথা না বললেই নয় বেকিং সোডা কখনই ত্বকে ডিরেক্ট অ্যাপ্লাই করা উচিত নয় এতে করে ত্বক পুড়ে যাওয়ার সম্ভবনা থাকে। সুতরাং রূপচর্চা করুন ঘরে বসে, সাজগোজ তো আছেই আপনার জন্য।
ছবি – ওয়েলবিংসিক্রেটস.কম
লিখেছেন – সাজিয়া