তিন পর্বের সিরিজের সর্বশেষ এবং সবচাইতে ভয়াবহ পর্ব এটি। যা লিখছি, ভিকটিমদের সাথে সরাসরি কথা বলে লিখছি। এ পর্বটি লিখতে গিয়ে সুতীব্র মানসিক যন্ত্রনার শিকার হয়েছি, শিউরে উঠেছি বার বার। প্রিয় পাঠক, তবুও অনুরোধ করছি আমার সাথে থাকুন এবং দেখুন, সমাজটাকে কি অন্ধকারাচ্ছন্ন নরকে পরিণত করেছি সবাই মিলে। শিশু নির্যাতন নয়, এ পর্বে লিখব বয়ষ্ক মেয়েদের উপর ঘটে যাওয়া নির্যাতন নিয়ে, পরিবারের সদস্যরাই যেটি ঘটিয়েছে।
সেলিম আর সাবেরা খালাত ভাইবোন, পিঠাপিঠি বড় হয়েছে। সেলিম সবে ভার্সিটিতে উঠেছে, আর সাবেরা এইচ এস সি সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। ভার্সিটি থেকে ছুটিতে দেশে এলে প্রায়ই সাবেরাদের বাসায় আসে সেলিম। সাবেরাও কিছু মনে করেনা, ভাই-ই তো।
সেলিম একবার প্রেমের প্রস্তাব দেয় সাবেরাকে, সাবেরা হেসেই উড়িয়ে দেয়। এই প্রস্তাব বারবার দিতে থাকায় এক পর্যায়ে সাবেরা হুমকি দেয় অভিভাবকদের জানিয়ে দেবার। সাবেরার মা একবার হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে নিয়ে হাসপাতাল যেতে হয় সাবেরাকে, খবর পেয়ে সেলিম আসে। হাসপাতাল থেকে সাবেরা বাসায় যাবে, সঙ্গী হয় সেলিম। তারপর?
প্যারালাইজড বাবার পাশের রুমে ছিন্নভিন্ন হয় সাবেরা, সেলিম নামক পশুটির হাতে।
প্রিয় পাঠক, এর চাইতেও বড় নিষ্ঠুরতা কোনটি জানেন? মা সুস্থ্য হবার পর সাবেরা যখন জানায়, উল্টো আপন মা তাকে “নষ্ট মেয়ে” বলে গালি দেয়, সে-ই নাকি সেলিমকে ফুঁসলেছে।
এরপর পেরিয়ে গিয়েছে বহু বছর।
সাবেরা আজ প্রতিষ্ঠিত, একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ায়। মা-কে সেই দেখে। সেলিম বেশিদূর এগুতে পারেনি, ছোটখাট চাকুরি করে। সাবেরা আমার সাথে যখন কথা বলছিল, ও বলছিল, জানেন মাসরুফ ভাই, সেলিমের চেয়ে আমি আমার মা কে বেশি ঘৃণা করি।
আমার অন্তত দুজন বান্ধবী আপন মামার দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়েছিল, মাকে জানানোর পর দুই মা-ই বেমালুম চেপে গিয়েছিলেন।
কেউ কি আমাকে বলবেন, একটা সমাজ কতটা পঁচে গেলে এমনটা হতে পারে? নিজের মেয়ের উপর ঘটে যাওয়া এত ভয়াবহ অন্যায়ের প্রতিকারের চাইতে লোকলজ্জার ভয়ে চেপে যাওয়াটা উত্তম?
রাতে ঘুমান কীভাবে আপনারা?
আপন দুলাভাই যদি বিত্তশালী হয় এবং পরিবারকে দেখে,ছোট শালীকে ভোগ করা তার অনেকটা নৈতিক দায়িত্বের ভেতরে পড়ে। একই কাহিনী খালু, চাচা, ফুপা ইত্যাদি যতরকম আত্মীয় আছে সবার ভেতরে।
ভিন্ন ধর্মাবলম্বী বাবা মায়ের ঘরে জন্মানো অনিমার জন্মই ছিল আজন্ম পাপ। বাবা মায়ের ছাড়াছাড়ি হবার পর মা আবার বিয়ে করে, সেই স্বামী ওকে প্রচন্ড পেটাতো। ও নানীর কাছে মানুষ, নানী মারা গেলে এক খ্রিষ্ঠান পাদ্রী ওকে দেখে রাখেন। সেই পাদ্রী আমেরিকা যাবার সময় ওকে খালা খালুর কাছে রেখে যান। সেই খালু ওকে সুযোগ পেলেই অত্যাচার করত। এক পর্যায়ে ও মায়ের কাছে যায়, মায়ের স্বামী পিটিয়ে বের করে দেয় তাকে। সেখান থেকে একটি জেলার খ্রিষ্ঠান মিশনের আশ্রয় নেয় ও। সেই মিশনের প্রধান বিশপ আশ্রয়ের বিনিময়ে ভোগ করতে চায় ওকে।
অনিমা স্বপ্ন দেখে, একদিন ও নিজের পায়ে দাঁড়াবে, শোধ নেবে সব অন্যায়ের। আমিও স্বপ্ন দেখি, বোনের মত এই মেয়েটি আর ওর ভালোবাসার মানুষটির পাশে দাঁড়াব, যাতে ওরা বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারে এ পৃথিবীতে।
সবচাইতে ভয়াবহ ঘটনাটি লেখার সময় এসেছে এবার। হাজী আসমত প্রভাবশালী ব্যবসায়ী, এলাকায় তার ভীষণ নাম ডাক। স্ত্রী পড়াশোনা জানে না, একটা মাত্র মেয়ে। হাজী আসমতের কাজ কি জানেন? বারো বছর বয়েস হবার পর থেকে এই মেয়েকে নিয়মিত ধর্ষণ করা। স্ত্রী টের পাবার পর তাকে বলে, “আমার মাইয়া আমি যা ইচ্ছা করুম, তুই বাধা দিলে মা মেয়ে দুইটারেই কাইটা ভাসায়ে দিমু”।
সালেহার বয়েস এখন চব্বিশ, একটা প্রাইভেট ভার্সিটিতে পড়ে। খরচ বাবাই দেয়, বিনিময়ে মাসে দুবার “যেতে” হয় বাবার কাছে। বারো বছর বয়েস থেকে নির্যাতিত হতে হতে এখন ওর বোধশক্তি লোপ পেয়েছে। আমাকে যখন বলছিল, পাগলের মত হাসছিল। আমি খোঁজ নিয়েছি, মিথ্যে বলেনি।
এটা ইউরোপ আমেরিকার ঘটনা নয়, খোদ বাংলাদেশের ঘটনা। যাঁরা বলেন আমাদের সমাজ ব্যবস্থা ইউরোপ আমেরিকার চেয়ে উন্নত, তাঁদের গালে একটা বড়সড় চপেটাঘাত হচ্ছে এই ঘটনাটি।
যদি বেঁচে থাকি, এর একটা প্রতিকার দেশে এসে করার ইচ্ছে আছে।
আমি শুধু সমস্যা তুলে ধরায় নয়, অ্যাকশন স্টেপ নেয়াতে বিশ্বাস করি।
পারিবারিক পারভার্টদের হাত থেকে বাঁচতে নীচের পদক্ষেপগুলো নেবেন:
(১) নিপীড়ক যেই হোক, চুপ করে থাকবেন না। প্রয়োজনে কেস করুন। লোকলজ্জা চুলোয় যাক।
(২) Trust ABSOLUTELY no one. “পুরুষের কলঙ্ক বিশ্বাস করিয়া ঠকা ভাল, তবুও অবিশ্বাস করিয়া নিপীড়ণের শিকার হইতে আমি রাজী নই”- শরৎবাবুর শ্রীকান্তের দুলাইন এই যুগে লেখা হলে ঠিক এরকম হত। কেউ ভালো না, নোবডি।
(৩) এখন তো মোবাইল ফোন ইত্যাদি আছে, বদমায়েশির প্রমাণ রেকর্ড করুন। তারপর সেটা নিয়ে পারিবারিকভাবে সাইজ দিন।
(৪) অনেক আগে অত্যাচার করেছে এখন বুড়ো? শুওরটাকে একা রুমে পেলে ঠাস ঠাস থাপ্পড় দিন। পাপের শাস্তি দেরিতে দিলে বরং মিষ্টি লাগে, revenge is a dish best served cold.
পুলিশ সার্ভিসে আমার চাকুরি আছে প্রায় ত্রিশ বছরের কাছাকাছি( যদি সব ঠিক ঠাক থাকে,স্রষ্টা সহায় হন)। ভেবে দেখলাম, এই ত্রিশ বছরে যদি ত্রিশটা মানুষের সত্যিকারের উপকার করতে পারি, I will consider myself a successful man.
এই “ত্রিশে-ত্রিশ” প্রকল্পের প্রথম ধাপ হচ্ছে সমাজের এই না বলা ক্ষতগুলো আমার সামান্য লেখনিতে আপনাদের সামনে তুলে ধরা। জানিনা কতদূর পেরেছি এটা করতে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর এক অতি ক্ষুদ্র সদস্য আমি, খুব বেশি কিছু করার সাধ থাকলেও সাধ্য নেই বললেই চলে।
তবু আপনাদের কাছে অনুরোধ, চুপ করে থাকবেন না। আপনি ভিকটিম হলে প্রতিবাদ করুন, আর যদি ভিকটিমের আত্মীয় হন তবে তার পাশে দাঁড়ান। আর যদি কিছুই না পারেন, ওই হতভাগিনীকে নিয়ে কুকথা বলাটা অন্তত বন্ধ রাখুন, প্লিজ!
আর যেসব নিপীড়ক আমার এই বাছাই করা ত্রিশের ভেতরে পড়বে, তাদের কদ্দুর কি হবে ওটা সময়ই বলে দেবে। এদেরকে আইনের আওতায় আনার সময় আল্লাহ পাক যেন আমার মন থেকে দয়া মায়া সব উঠিয়ে নেন, এই কামনা করি।
নিপীড়ণ দূর হোক, আমাদের মেয়েরা জেগে উঠুক- এই আপনার আমার হাত ধরেই!
সংযোজনী: শেষের ঘটনাটি পারিবারিক পারভারশনের নিকৃষ্টতম রূপ এবং একটি এক্সট্রিম কেস। এটি অস্বাভাবিক ঘটনা এবং বিরল, তবে এর অস্তিত্ব আছে। আমাদের সমাজের ভঙ্গুর রূপ উন্মোচন করতে এই ঘটনাটি উল্লেখ করা হয়েছে, পিতা ও সন্তানের পবিত্র সম্পর্ককে প্রশ্নবিদ্ধ করতে নয়।
লিখেছেন - মাসরুফ হোসেন