আপনি যদি আমার মত হয়ে থাকেন, দেহ কমানো আপনার জন্যে সেই লেভেলের কঠিন। মিষ্টির সাথে আমার প্রথম স্মৃতি সম্ভবত তিন বছর বয়েসে।আম্মু পায়েস রান্না করে খেতে বলেছিলেন, আমি মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিলাম।”এক চামচ মুখে দিয়ে দেখ”- বলে মুখে এক চামচ দিতেই গম্ভীর মুখে আমার বক্তব্য-” এক চামচ না, একশ চামচ দাও!”
সেই যে মিষ্টি পছন্দ হল, এখনও এর প্রতি ভালবাসা যায়নি। রাজশাহী মিষ্টান্ন ভান্ডারের প্যাঁড়াসন্দেশ, সাতক্ষীরা ঘোষ ডেয়ারির সরপুরিয়া, চট্টগ্রামে বনফুল মিষ্টান্ন ভান্ডারের মতিচুরের লাড্ডূ, ঢাকার বিক্রমপুর মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের সকাল বেলার রাবড়ি (সাথে পরোটা) এবং বালুসাই, আর একেবারে কোথাও কিছু না পেলে চুরি করে খাওয়া আখের গুড়- আহা!!!!
এক দু টুকরো মিষ্টি মাঝে মাঝে খাওয়াটা দোষের কিছূ না।আমার সমস্যা ছিলো অন্য জায়গায়। জাপানে প্রথম বছর প্রতিদিন এভারেজে আমার মিষ্টি জিনিস খাবার পরিমাণ ছিল এরকমঃ
১) এক লিটার কোক
২) দুটো রেগুলার চীজ কেক/চকোলেট প্যাস্ট্রি/ব্রাউনি
৩) একটা রাইস পুডিং উইথ হুইপড ক্রীম
৪) ম্যাংগো ফ্লেভারড আইসক্রীম
৫) পাঁচটা কিটক্যাট বার
৬) দুটো স্নিকারস বার
৭) দুই প্যাকেট এম এ্যান্ড এম চকোলেট (কুড়মুড়ি হিসেবে)
৮) সানি ভাইয়ের দোকানের লাচ্ছি উইথ আইস ক্রিম (বিরিয়ানির পর)
৯) অতিরিক্ত শীত পড়লে ম্যাঙ্গো/স্ট্রবেরি ফ্লেভারড বিয়ার ( এ্যালকোহলের পরিমান ৩-৫%, চিনির পরিমান বাকি পুরোটাই)
উপরের এইসব জিনিস আমি প্রতিদিন খেতাম, এবং এর একটাও বাদ পড়লে মনে হত কি জানি খাইনি।ভরপেট বিরিয়ানি খেলেও এগুলো না খেলে আমার চলতনা। ওজন যে একশ পাঁচ কেজি ছাড়িয়ে গিয়েছিল, এটা কি এমনি এমনি???
ফিজিকাল ফিটনেস এর যাত্রা শুরু করার পরে দেখলাম, এই “যত খাই তত চাই” রেসপন্স আমার একার না, এটা খুব কমন- এবং এর পেছনে নিখুঁত সায়েন্টিফিক ব্যাখ্যা রয়েছে।অতি সংক্ষেপে , সহজবোধ্য ভাষায় এই দুষ্টচক্রকে নীচের কয়েকটা ধাপে ব্যাখ্যা করা যায়ঃ
প্রথম ধাপঃ খাবার প্লেটের পাশে রাখা চকোলেট ব্রাউনির প্লেট থেকে একটার বদলে তিনটা নিয়ে আলগোছে মুখে পুরে দিলেন, প্রচন্ড সুখে আপনার মনে হতে লাগল জিহবা দিয়েই স্বর্গসুখ পেয়ে যাচ্ছেন ( আহা!)
দ্বিতীয় ধাপঃ ব্রাউনি মুখে দেবার সাথে সাথে মস্তিষ্কে ডোপামিন নামের হরমোন ছড়িয়ে পড়ল( এইটা সুখানুভূতির হরমোন, আপনার হালকা নেশা নেশা টাইপ আনন্দ লাগবে), রক্তে চিনির মাত্রা বেড়ে গেল, এবং এই চিনির মাত্রাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে শরীরের অগ্নাশয় থেকে ইনসুলিন নিঃসরণ বেড়ে গেল।
তৃতীয় ধাপঃ অতিরিক্ত ইনসুলিন রক্তে চলে আসায় দুটো জিনিস হবে- ১) দেহের ফ্যাট সেল গুলোতে ফ্যাট জমা হবে এবং ২) রক্তের অতিরিক্ত সুগার লেভেল ধপ করে নেমে যাবে।
চতুর্থ ধাপঃ সুগার লেভেল ধপ করে নেমে যাওয়ায় শরীরে সেই ঘাটতির অনুভূতি পূরণ করতে আবারও দুটো চকলেট ব্রাউনি খেতে প্রাণ আনচান আনচান করবে।এদিক ওদিক তাকিয়ে প্লেটে অবশিষ্ট চকোলেট ব্রাউনিদুটো আপনি খপ করে ছোঁ মেরে গিলে ফেলবেন- আহ, স্বর্গসুখ রিভিজিটেড এবং আগের তিনটা ধাপের পুনরাবৃত্তি!!!
উপরের কথাগুলোর মাসরুফীয় সারমর্ম( মানে আমি যা বুঝলাম) হচ্ছে, “সুমো পালোয়ান হতে চান? বেশি বেশি চিনি খান!”
যত ইচ্ছা ব্যায়াম করেন, সুগার আর কার্বোহাইড্রেট বাদ না দিলে সুমো থেকে সামুরাই হবার কো-ন-ও সম্ভাবনা নাই আপনার।
সিলেটে কাউন্টার টেররিজম শর্টকোর্স করতে গিয়ে মেজর মঞ্জুর আর মেজর আশরাফ স্যার আমার জীবনটাকে ভাজা তেজপাতা বানিয়ে দিয়েছিলেন।তাঁদের আশির্বাদে হেলিকপ্টার থেকে ঠিকই লাফ দিয়েছি, কিন্তু ওজন একটুও কমাতে পারিনি।
কীভাবে কমবে? ডায়নিং হলে তিন প্লেট উঁচু করে ভাত আর সাত গ্লাস স্পেশাল চিনিদার লেবুর শরবত কেউ যদি খায়- কমান্ডো ট্রেনিং এর বাবাও তার ওজন কমাতে পারবেনা।
ওজন কমাতে চান? সুমো থেকে সামুরাই হতে চান? প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে যতরকম মিষ্টি জিনিস আছে সব ছেঁটে ফেলুন। মিষ্টির সংজ্ঞা হচ্ছে, জিহবায় যা মিষ্টি লাগে তা-ই মিষ্টি, সেটা ফল হোক বা মধু দিয়ে রান্না করা চিকেনের স্পেশাল রেসিপি হোক। If its sweet, its not your food.
একেবারেই যদি না পারেন, এক দুই টুকরো মিষ্টি ফল (আপেল, পেঁপে ইত্যাদি) খাবেন।
যুদ্ধ জারি রাখুন!!
(এ লেখাটি সাধারণ জ্ঞানের উদ্দেশ্যে লেখা, যে কোন অবস্থায় ডাক্তারের পরামর্শকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিন।মনে রাখবেন, প্রফেশনাল এ্যাডভাইসের বিকল্প কখনোই ফেসবুক নোট নয়)
আট সপ্তাহে ১৪ কেজি ওজন কমালাম কীভাবে? (পর্ব ১ )
আট সপ্তাহে ১৪ কেজি ওজন কমালাম কীভাবে? (পর্ব ২)
আট সপ্তাহে ১৪ কেজি ওজন কমালাম কীভাবে? (পর্ব ৩)
আট সপ্তাহে ১৪ কেজি ওজন কমালাম কীভাবে? (পর্ব ৪)
ছবি এবং লিখেছেন - মাসরুফ হোসেন