অনেক মহিলাই আছেন, যাদের মেনোপজ এর সময় এগিয়ে আসছে এবং এটা নিয়ে তাদের মধ্যে একটা চাপা আতংক বা দুশ্চিন্তা কাজ করে। অনেকে আবার এটা নিয়ে কুসংস্কারে ভোগেন। এই সময়টা সব মহিলাকেই ফেস করতে হবে, তাই অহেতুক চিন্তা না করে, এই সময় কি কি হতে পারে এবং তার বিপরীতে কী কী করা যেতে পারে, সেগুলো সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকলে বিষয়টা মোকাবেলা করা অনেক সহজ হয়ে যাবে।
মেনোপজ কী, কেন হয় ও এর লক্ষণসমূহ
মেনোপজ কী?
প্রথমেই, মেনোপজ (menopause) কী সেটা নিয়ে একটা ক্লিয়ার ধারণা থাকা দরকার। মেনোপজ মহিলাদের জন্য খুব স্বাভাবিক একটা অবস্থা, যেটা সাধারণত বয়েস চল্লিশ পার হবার পরে সকলেরই হয়ে থাকে। একজন মহিলার স্বাভাবিক সন্তান উৎপাদন ক্ষমতা ক্রমশ হ্রাস পাওয়া এবং রিপ্রোডাকশন পিরিয়ড সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঠিক আগের সময়টায় যে শারীরিক এবং মানসিক পরিবর্তনগুলো আসে, সেগুলোকেই মেনোপজের শুরু বলা যায়।
মেনোপজ কেন হয়?
একজন মহিলা সাধারণত একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ ডিম্বাণু নিয়ে জন্ম গ্রহন করেন, যেগুলো তার জরায়ুতে সংরক্ষিত থাকে। জরায়ু মহিলাদের শরীরের ইসট্রোজেন এবং প্রজেসটেরন হরমোন তৈরি করে, যেটা প্রতিমাসের মাসিক এবং ওভাল্যুশনকে নিয়ন্ত্রন করে। যখন জরায়ু থেকে ডিম্বাণু নিঃসরণ বন্ধ হয়ে যায় এবং মাসিক বন্ধ হয়ে যায়, তখনই মেনোপজ হয়।
মেনোপজের ধাপ কয়টি?
মেনোপজ এর তিনটি ধাপ রয়েছে। যথাক্রমেঃ পেরিমেনোপজ, মেনোপজ এবং পোষ্ট মেনোপজ। মেনোপজ শুরুর আগের কয়েক বছর সময়কে বলা হয় পেরিমেনোপজ। এইসময় আস্তে আস্তে মেনোপজ এর লক্ষণ দেখা দিতে শুরু করে। অর্থাৎ মেনোপজ শুরুর দুই থেকে তিন বছর আগে থেকেই এই প্রক্রিয়াটি শুরু হয়ে যায়। আর মেনোপজ হচ্ছে এই প্রক্রিয়া শুরুর পর থেকে এক বছর পর্যন্ত সময়কালকে।
এই সময় যে যে শারীরিক পরিবর্তন সেগুলো নিয়ে অনেকেই সমস্যায় পড়েন। যেটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু এগুলো ধামাচাপা দিয়ে না রেখে বরং কাছের মানুষ, প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া উচিত।
মেনোপজ এর লক্ষণ
১) হট ফ্ল্যাশ
মেনোপজ এর সময় যে জিনিসটা সকলকে খুব ভোগায় তা হলো হট ফ্ল্যাশ (Hot Flash)। বাইরের কোনও উৎস ছাড়াই হঠাৎ করে ভীষণ গরম লাগা। সেটা খুব ঠাণ্ডার দিনেও হতে পারে। এর সময়কাল কয়েক সেকেন্ড থেকে শুরু করে মিনিট দশেক পর্যন্ত হতে পারে। এক্ষেত্রে সঙ্গে সঙ্গে ঠাণ্ডা পানি খেতে পারেন। একটু ঢিলে সুতির কাপড় পড়তে পারেন। এতে হট ফ্ল্যাশ হলেও স্বস্তিতে থাকবেন।
২) চুল পড়া
মেনোপজ এর সময়ে হঠাৎ করে অনেক চুল পড়া শুরু হয়। এতে অনেকে খুব অস্বস্তিতে ভোগেন নিজেদের বাহ্যিক পরিবর্তনে। কিন্তু এটা মনে রাখতে হবে যে চুল পড়াটা স্থায়ী কিছু না। মূলত ইসট্রোজেন এবং প্রজেসটেরন হরমোন এর উৎপাদন কমে যাওয়ার কারণে চুল পাতলা হওয়া শুরু হয়। এটা একেবারে থামানো সম্ভব না। তবে স্ট্রেস ফ্রি থাকা, নিয়মিত ব্যায়াম করা, পুষ্টিকর ডায়েট মেনে চলা, ভিটামিন সাপ্লিমেনট নেয়া ইত্যাদি চুল পড়ার হার অনেকটা কমিয়ে আনতে পারে।
৩) যৌন মিলনে অনিহা
ইসট্রোজেন এবং প্রজেসটেরন হরমোন এর উৎপাদন কমে যাওয়ার কারণে শারীরিকভাবে যৌন মিলনের আগ্রহ অনেকটা কমে যায়। পাশাপাশি ইসট্রোজেন হরমোন কমে যাওয়ায় যোনিপথ অনেক বেশি শুষ্ক হয়ে থাকে, যে কারণে যৌন মিলন মহিলাদের জন্য কষ্টদায়ক হয়ে যায়। এই সমস্যা দূর করতে ঘরোয়া টোটকা বা এর ওর কথা না শুনে ডাক্তারের পরামর্শ নেয়াই শ্রেয়।
৪) মুড সুইং
এসময় শরীরে ইসট্রোজেন হরমোন এর ঘাটতি থাকে বলে সেরেটোনিন এবং ডোপামিন হরমোন এর ইমব্যালান্স দেখা দেয় শরীরে। যে কারণে ঘন ঘন মুড বদলাতে থাকে। এর আরও একটি কারণ হলো এসময়ের অন্যান্য শারীরিক পরিবর্তন। যেমন- ওজন বেড়ে যাওয়া, চুল পড়া, হট ফ্ল্যাশ। এগুলোর কারণেঅনেকেই সারাক্ষণ স্ট্রেস এ ভোগেন যেটা থেকে তুচ্ছ কারণে খিটখিটে মেজাজ দেখা দেয়। তবে নিয়মিত ব্যায়াম, নিয়ম করে হাঁটা, পর্যাপ্ত ঘুম এবং স্ট্রেস ফ্রি থাকতে পারলে এ সমস্যা অনেকটাই কমে যায়।
৫) জয়েন্ট পেইন
শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ব্যথা, বিশেষ করে হাঁটু, কনুই, আঙ্গুল, পিঠ এইসময় থেকে শুরু হতে থাকে। তবে মেনোপজ ছাড়াও কারো যদি আথ্রাইটিস, লুপাস এবং বারসাইটিস এর সমস্যা থেকে থাকে তাহলে এই ধরনের ব্যথা বেশ খারাপ আকার ধারন করে। সবচেয়ে দুঃখজনক হলো এগুলোর কোন স্থায়ী চিকিৎসা নেই। বিভিন্ন ধরনের থেরাপি, ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ, ওজন নিয়ন্ত্রন এই ব্যথার কিছুটা উপশম করে থাকে।
৬) ওজন বৃদ্ধি
মেনোপজের সময়ে দ্রুত ওজন বৃদ্ধি একটা অন্যতম সমস্যা। এটার কারণে হাঁটু , কোমর এবং পিঠের ব্যথায় ভোগেন অনেকে। এই সময় যেহেতু ইসট্রোজেন এবং প্রজেসটেরন হরমোন হ্রাস পায় শরীরে তাই সন্তান উৎপাদন ক্ষমতাও কমতে থাকে। এই হরমোনের অভাবে ওজন নিয়ন্ত্রন করাও কষ্টকর হয়ে পরে আস্তে আস্তে। এছাড়া বয়সের এই ধাপে এসে পারিপার্শ্বিক অনেক কিছুই ওজন বৃদ্ধির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যেমন, এসময় ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে চাকরি, পড়াশোনা বা বিয়ের কারণে দূরে চলে যায়। চাকরিজীবীদের পেনশনে চলে যাওয়ার সময় চলে আসে। এসব কারণে মনের অস্থিরতা বাড়ে। তাই চল্লিশের পর থেকেই পরিমিত খাবার এবং নিয়মিত ব্যায়াম করা খুব জরুরি। কেননা, এই ওজন বৃদ্ধির ফলে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং ক্যান্সারের ঝুঁকিও বেড়ে যায়।
৭) অনিদ্রা
মেনোপজ এর সময়ে মহিলাদের আরেকটা সমস্যা হলো ঘুম না হওয়া বা ঘুম হলেও ঘুম থেকে ওঠার পরেও সারাদিন ঘুম ঘুম লাগা বা ক্লান্তি লাগা । অনেকের ক্ষেত্রেই দেখা যায় রাতে ঘুম থেকে উঠে বসে আছেন। যার কারণ হট ফ্ল্যাশ বা প্রচণ্ড ঘেমে যাওয়া। আবার এই বয়সে অনেকে ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্ত চাপ বা অন্য কোন অসুখের কারণে ওষুধ শুরু করেন। এসব ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হিসেবেও অনিদ্রা হতে পারে। এক্ষেত্রে অনেকে ঘুমের ওষুধ খাওয়া শুরু করেন, যেটা একেবারেই ঠিক না। শুধু মাত্র ডাক্তারের পরামর্শেই ঘুমের ওষুধ খাবেন। ভালো ঘুম হওয়ার জন্য নির্দিষ্ট ঘুমের সময়, উপযুক্ত ব্যায়াম, ক্যাফেইন গ্রহন কমিয়ে আনা এই কাজগুলো বেশ ভালো কাজ দেয়।
পরিশেষে বলবো, মেনোপজ খুব স্বাভাবিক একটা প্রক্রিয়া। যেটা একটা বয়সের পরে সব মহিলাদের গ্রহন করতে হবে। এই সময়ে যেহেতু হুট করে শারীরিক একটা বড় ধরনের পরিবর্তন আসে, সেটা নিয়ে অনেকেই হীনমন্যতায় ভোগেন, ডিপ্রেশনে পরে যান। কিন্তু পুরো বিষয়টাকে সহজভাবে গ্রহন করলে এবং পরিবারের কাছের মানুষের সাপোর্ট পেলে পুরো ব্যাপারটাই অনেক সহজ হয়ে যায়। ভালো থাকুন, সুন্দর থাকুন।
ছবি সংগৃহীতঃ ইমেজেসবাজার.কম; নিউজ মেডিক্যাল.নেট
The post মেনোপজ কী, কেন হয় ও ৭টি লক্ষণ সম্পর্কে কতটুকু জানেন? appeared first on Shajgoj.