ইদানিং একটা প্রবণতা বেশ লক্ষ্য করছি, (হয়ত আগেও এমনটাই ছিল, আমার জন্য নতুন আর কি! ) আমাদের পাঠকরা বেশ কড়া ভাষায় লিখছেন-
‘আপনারা তো অনেক হোম রেমেডি দেন, কিন্তু আমি অনেক বিজি (?) একটা ক্রিমের নাম বলুনতো যেটা দিলে সব ব্রণের দাগ চলে যাবে!!’
(ওদিকে সম্মানিত পাঠক কিন্তু ব্রণ কীভাবে একটু কমবে, তা জানতে চাচ্ছেন না!! তবে কী ব্রণ উঠতেই থাকবে আর আপনি সারাজীবন ক্রিম(!) মাখতেই থাকবেন??
আবার এই পাঠকের কথাই ধরি-
‘হাত পা দিন দিন কালো হচ্ছে। একটা লোশনের নাম বলুন, যেটা দিলে ব্রাইট হব…’
(আমি পিসির স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে একটু শব্দ করেই হাসছিলাম!)
ব্রাইট হতে চান ভালো কথা, কিন্তু সান্সক্রিন মাখবেন না, ঘরে কেয়ার নেয়ার সময় নেই!! তবে তিনিও কি সারাজীবন সান্সক্রিন না দিয়ে রোদে যাবেন, কালো হবেন আর লোশন মাখতেই থাকবেন!!! বেশ মজার ব্যাপারটা, প্যারাডক্সের মত। অপূর্ব এক ঘূর্ণিপাক!!
আচ্ছা, তো এটা ছিল ক্রিমের উপর আমাদের পাঠকদের অগাধ বিশ্বাসের কিছু নমুনা। এখন আমি ‘ক্রিমের’ / ময়েশ্চারাইজারের একটা সংজ্ঞা দেব। একটু মনোযোগ দিয়ে পড়ুন।
***ক্রিম/ময়েশ্চারাইজার আসলে কী?
ময়েশ্চারাইজার হচ্ছে ত্বকের উপরে একটি হাল্কা অদৃশ্য আস্তর তৈরি করে ত্বকের ওয়াটার মলিকিউলস (পানির অনু) কে ত্বক থেকে বাইরে চলে যাওয়ার পথে বাধা প্রদানকারী উপকরণ। মুখ পানি দিয়ে ধুয়ে এটা লাগানো হয় যখন ত্বকের আদ্রতা সবচেয়ে বেশি থাকে। এতে এক্সট্রা এই পানি ত্বকে আটকা পড়ে যায় স্কিন শুকিয়ে যেতে দেয় না। এবং এই কারণে ক্রিম/লোশন সবসময় গোসল/মুখ ধোয়ার পর পরই ব্যবহার করতে বলা হয়।
এবার আসা যাক স্কিনকেয়ারের এই মোস্ট পপুলার আইটেম নিয়ে সবচেয়ে প্রচলিত কিছু ভুল ধারণার ব্যাপারে-
১। ক্রিম মাখলে ত্বক ফর্সা হয়-
এই ভুল ধারণার জন্য অত্যন্ত বিখ্যাত কিছু ফেয়ারনেস ক্রিম দায়ী। আমরা এই ভয়ঙ্কর ক্ষতিকর প্রোডাক্ট সম্পর্কে কোন কমেন্ট করব না। কারণ ত্বক ব্লিচ করে ক্যান্সারের ঝুঁকি তৈরি করাকে আমরা স্কিনকেয়ার বলি না। এই বোকামি কেউ করতে চাইলে নিজের রিস্কে করুন। ক্রিম অথবা লোশনের প্রধান উপাদান হচ্ছে আদ্রতা দেয় এমন উপাদান এবং ক্রিমের ঘনত্ব প্রদানকারী বেস। এতে কখনই এমন বেশি পরিমানে একটিভ উপাদান রাখা হয় না যেগুলো স্কিন কালারে অথবা রোদে পোড়া দাগে কোন দৃশ্যমান পরিবর্তন আনতে পারে। কারণ এসব উপাদান প্রচুর দামি হয় এবং এগুলো খুব সহজে নষ্ট হয়ে যায় বলে প্রোডাক্টের প্যাকেজিংয়েও অনেক খরচ পড়ে।
এখন আপনারা বলুন যেখানে পপুলার ক্রিম মাখলে ফর্সা হবেন এই কথাতেই ভ্রমরের মত কাস্টমার এসে আমাদের দেশে প্রোডাক্ট কিনে নিয়ে যায় তবে সেই বিক্রেতা কেন এত দামি উপাদান এবং প্যাকেজিং এর পেছনে টাকা নষ্ট করবে? তার মুনাফার হার কমিয়ে??
ক্রিমের কাজ ত্বকের পানির কণা ধরে রাখা এবং যখন একটা প্রোডাক্ট সেটা প্রমাণিতভাবে করতে পারে তখনি প্রস্তুতকারক সেটাকে বাজারজাত করে। আধুনিক দুনিয়ায় বিভিন্ন আইনের মাধ্যমে বিক্রেতার মিথ্যাচার বন্ধ করা হয় যাতে আকাশকুসুম স্বপ্ন দেখিয়ে ক্ষতিকারক প্রোডাক্ট বিক্রি তারা না করতে পারে। কিন্তু আমাদের উপমহাদেশে এমন আইন নেই অথবা আইনের প্রয়োগ কোনটাই না থাকার কারণে এখনও যেকোন ক্রিমের গায়ে বিক্রেতারা যখন তখন-
‘ ইহা মাখুন আর মেমসাহেবদের ন্যায় ফর্সা হউন!!!!’
তকমা সেঁটে দেয়ার দুঃসাহস দেখায় এবং মানুষের অজ্ঞতার সুযোগে মুনাফা লোটে। সুতরাং, আপনি অনেক বিজি, শুধু ক্রিম মাখা ছাড়া আর কিছু করার সময় নেই। এসব কথা আবার বলার আগে চিন্তা করবেন তো একটা কসমেটিকের পেছনে মিছি মিছি অনেকগুলো টাকা ঢেলে দেয়ার মতন এক্সট্রা টাকা আপনার আছে কিনা??
আর এটাও মনে রাখুন, ঘরোয়া পদ্ধতি আপনাকে ২ সপ্তাহে ফর্সা বানাতে না পারলেও ১ মাসে ত্বকের রোদে পোড়া দাগ, মরা চামড়া, অমসৃণ অংশ কিন্তু অবশ্যই কমাতে পারবে!! এবং আমরা যারা দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন স্কিন কেয়ারে এসব ঘরোয়া টোটকা ব্যবহার করেই ফল পাচ্ছি, বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, আমরাও কিন্তু অনেক বিজি। পার্থক্য শুধু একটাই। আমরা টাকার অপচয় না করে সবচেয়ে ইফেকটিভ রাস্তা বেছে নিয়েছি আর আপনি জ্ঞানের অভাবে কষ্টার্জিত টাকা ঢেলেই চলেছেন এবং ভবিষ্যতেও ঢালবেন………!!!
২। তৈলাক্ত ত্বকে ক্রিম মাখার দরকার নেই-
আমাদের দেশে বহুল প্রচলিত আরেকটি মিথ। আপনাদের অবগতির জন্য জানাচ্ছি। অনেকেরই তৈলাক্ত ত্বকের আসল রূপটি আসলে ডিহাইড্রেটেড অয়েলি। মানে, আপনার স্কিন থেকে পানি এতটাই দ্রুত চলে যায় যে আপনার স্কিন পাগলের মত তেল তৈরি করে স্কিনের উপরে লেয়ার তৈরি করে পানির কণাগুলোকে আটকানোর জন্য। যতটা সেবাম/তেলের আসলে দরকার নেই। আর এই অতিরিক্ত তেলের কারণে এই ত্বকের লোমকূপ তেলে ভরে অনেক বড় বড় দেখায়। এই তেল বাতাস থেকে রাজ্যের ময়লা ধুলা স্কিনে ট্র্যাপ করে ব্ল্যাকহেড , হোয়াইটহেড অথবা ব্রনের মত প্রব্লেম তৈরি করে। আমরা মনে করি স্কিন অয়েলি সুতরাং অনেক ক্ষারীয় ফেসওয়াশ দিয়ে মুখ ধুই। এবং দরকার মত ময়েসচারাইজার লাগাই না। ফলে স্কিন আবারো পাগলের মত পানি বাচাতে তেল তৈরি করা শুরু করে। ফলাফল, জীবনভর ব্রন, এক্সট্রা অয়েল এসব সমস্যা।
সুতরাং যাদের অয়েলি স্কিন তারা অবশ্যই কোন হাইড্রেটিং টোনার অথবা জেল বেসড ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করবেন। দেখবেন, স্কিনের অয়েলিনেস একটু হলেও কমবে।
৩।একটা ক্রিম সকাল/রাত/শীত/গ্রীষ্মে ব্যবহার করতে হবে-
একটা ক্রিম কিনে সেটাকে বছরের পর বছর ব্যবহার করলে আসলে শুধু এই প্রোডাক্টের বিক্রেতা ছাড়া আর কারো কোন লাভ হয় না। কারণ সেতো আপনাকে বড়শিতে গেঁথে ফেলেছে। আপনার মত মানুষের জন্য তার মুনাফা লাখে লাখে বাড়ছে।
একটা ক্রিম একনাগাড়ে বছরের পর বছর ব্যবহার করতে হবে এমন থিওরি শুধু ঠগ জোচ্চোর বিক্রেতারাই দেয়। কারণ আপনার স্কিন প্রতি ১ মাসে একবার করে চেঞ্জ হয়। পুরনো কোষ ঝড়ে পড়ে গিয়ে নতুন কোষ তৈরি হয়। সুতরাং এই চেঞ্জের সময় ক্রিম ব্যবহার করলে আপনি যে পরিবর্তন টুকু দেখবেন সেটার পর আসলে আপনার স্কিনে আর কোন চেঞ্জ আসবে না। সুতরাং, নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের প্রতি এত ভক্তির আসলে কোন সায়েন্টিফিক ভিত্তি নেই।
একটা ক্রিম আছে আপনার, যেটা হয়ত আপনি রেগুলার ব্যবহার করেন। কিন্তু আজ অনেক বেশি গরম/ ঠাণ্ডা। আপনি বুঝতে পারছেন এই প্রোডাক্ট আজকে আপনার প্রয়োজন পূরণ করবে না। তবুও জোর করে সেটা কেন মাখবেন???
অনেকেই আছেন ক্রিমকে ডাক্তারের ওষুধের মত মনে করেন। যে রোজ রোজ মাখতে হবে। ভালো না লাগলেও, স্কিনে প্রবলেম হলেও!! নইলে মনে হয় এতদিনের সব ফলাফল একদিনে মুছে যাবে।
না। ফেস ক্রিম কোন অ্যান্টিবায়টিক কোর্স নয়। এটা আপনার প্রয়োজন বুঝে ব্যবহার করুন। একটা প্রোডাক্ট সবসময় লাগাবেন না। স্কিনের দরকার বুঝে প্রোডাক্ট কিনুন। যেমন- দিনের জন্য হাল্কা কিছু যাতে সান-প্রটেকশন আছে। আর রাতের জন্য একটু একটিভ উপাদান যুক্ত কিছু যা আপনার ঘুমের সময়ে আপনার স্কিনের প্রবলেমগুলো সারাতে হেল্প করবে।
গরমের সময়ে হাল্কা, ম্যাট ফিনিসের কোন প্রোডাক্ট। আবার শীতের জন্য একটু ভারী কিছু।
মনে রাখবেন, প্রত্যেক মানুষের স্কিন আলাদা। আর স্কিন সবসময় আমাদের বয়স, আবহাওয়া, পরিবেশের কারণে চেঞ্জ হতে থাকে। তাই সবসময় একি প্রোডাক্ট ইউজ করে যদি আপনি মনে করেন, গুন অংকের মত এই ক্রিম বছরের পর বছর ব্যবহার করলে আপনার স্কিন ২*২=৪ , ২*৩=৬ এমনভাবে উন্নতি করবে তবে জেনে রাখুন- আপনি ভুল পথে টাকা এবং সময় নষ্ট করছেন। কারণ যেকোনো প্রোডাক্টের পূর্ণ ক্ষমতা সে ১-১.৫ মাসের মধ্যেই দেখিয়ে ফেলে।
জানি টিভি পত্রিকায় ক্রমাগত বিভিন্ন অ্যাড দেখেন যাতে দেখানো হয় ক্রিম মাখার পড় ত্বকের উপর থেকে একটা মুখোশ সরে গিয়ে অপূর্ব সুন্দর ত্বক নিচ থেকে বের হয়ে আসে!!! কিন্তু আজকের লেখার উদ্দেশ্য ছিল আসলে আপনাদের চোখের উপর থেকে পর্দাটা একটু সরানোর।
শুধু এতুকুই মনে রাখবেন,
সময় নেই নিজের যত্ন নেয়ার এই কথা বলবেন একদিকে এবং অন্যদিকে বোকার মত চিপ কিছু মার্কেটিং প্লয়তে পা রেখে রোজ আয়নার সামনে দাড়িয়ে মনে অনেক আশা নিয়ে ক্রিম ঘষবেন আর বোঝার চেষ্টা করবেন স্কিন আগের চেয়ে একটু ফর্সা দেখাচ্ছে কিনা!!!!
জী না, প্রিয় পাঠক, স্কিন কেয়ার এত সহজ নয়!!!
লিখেছেন – তাবাসসুম মুস্তারি মীম
ছবি – টকিংমেকাপ.কম, ডিআইওয়াইন্যাচারাল.কম