ছোট্ট শিশুরা পাখির মত। হাসবে খেলবে, আনন্দে ঘর ভরিয়ে রাখবে। কিন্তু সেই ছোট্ট শিশুর যদি হটাৎ খিঁচুনি হয় তাহলে মা-বাবার দুশ্চিন্তার অন্ত থাকে না। সাধারণভাবে শিশুদের জ্বরজনিত খিঁচুনি হয়; অর্থাৎ জ্বরের সঙ্গে খিঁচুনি সম্পর্কিত। এতে মস্তিষ্কের কোনো ক্ষতি হয় না। তবে পাঁচ-ছয় বছর বয়স পর্যন্ত এই খিঁচুনি বারবার হতে পারে। ইনফেকশন, শরীরে গ্লুকোজের মাত্রা কমে যাওয়া, জন্মগত মস্তিষ্কের সমস্যা, সেরিব্রাল পালসি ছাড়াও বিভিন্ন রোগে শিশুর খিঁচুনি হতে পারে। জ্বর, আঘাত বা অন্য কারণে যেমন মৃগী বা এপিলেপসি রোগেও শিশুর খিঁচুনি হতে পারে।তবে সব খিঁচুনিতেই বেশি ভয়ের কিছু নেই। আর খিঁচুনি মানেই যে তা মৃগী রোগ এমনটাও নয়। আজকের লেখায় জেনে নিন তবে শিশুদের খিঁচুনি রোগ সম্পর্কে!
খিঁচুনি ও মৃগী রোগ দুটির পার্থক্য ও শিশুদের ক্ষেত্রে চিকিৎসা
১) শিশুর খিঁচুনি বা ফেব্রাইল কনভালশন
৬ মাস থেকে ৬ বছর বয়সের শিশুর জ্বর ১০৩ ডিগ্রি ফারেনহাইট হলেই অনেক সময় খিঁচুনি শুরু হয়, যা ফেব্রাইল কনভালশন নামে পরিচিত। সব ক্ষেত্রে খিঁচুনি বা কনভালশন-এর কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে কিছু কিছু রোগের কারণে জ্বরের মাত্রা বেশি হলে কনভালশন শুরু হয়। এসব রোগের মধ্যে তীব্র কাশি, নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, কান দিয়ে পুঁজ পড়া, প্রস্রাবের নালিতে ইনফেকশন অন্যতম। বাচ্চাদের এই খিঁচুনি দেখতে খুবি অস্বস্তিকর এবং কষ্টকর হলেও এতে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। এতে আপনার বাচ্চার কোন ক্ষতি হবে না। ফেব্রাইল কনভালশন-এ ব্রেইন ড্যামেজ হয় না এবং এ থেকে মৃগী রোগ হওয়ার ও ঝুঁকি নেই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উচ্চ তাপমাত্রার জ্বরের জন্য বাচ্চারা খুব অল্পই ভুগে থাকে। প্রতি ৩০ জনে একজনের কনভালশন বা খিঁচুনি হতে পারে।
ফেব্রাইল কনভালশন এর চিহ্ন ও লক্ষণসমূহ
১. অতি উচ্চ তাপমাত্রার জ্বরের সাথে বাচ্চা জ্ঞান হারিয়ে ফেলতে পারে।
২. চোখ পিটপিট করা, এক দৃষ্টিতে তাকানো অথবা চোখ উল্টে যাওয়া।
৩. শরীর, বিশেষ করে হাত ও পা কাঁপা।
৪. প্রস্রাব-পায়খানার নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা হারানো।
৫. মাংসপেশি শক্ত হয়ে যেতে পারে বা কাপতে পারে।
৬. বাচ্চার মুখ লাল বা নীল হয়ে যেতে পারে।
৭. খিঁচুনি কয়েক মিনিট স্থায়ী হতে পারে।
৮. খিঁচুনি থেমে গেলে বাচ্চার জ্ঞান ফিরে আসবে, কিন্তু জ্ঞান ফিরলেও বাচ্চা ঘুম ঘুম ভাব বা খিটমিটে হয়ে থাকতে পারে।
কী করবেন বাচ্চাদের খিঁচুনি হলে?
সাধারণত এ ধরনের খিঁচুনি তখনই হয় যখন বাচ্চার শরীরের তাপমাত্রা হুট করে বেড়ে যায়। অনেক সময় অভিভাবক খিঁচুনি না ওঠা পর্যন্ত টেরই পান না যে, বাচ্চার জ্বর এসেছে। একবার খিঁচুনি শুরু হয়ে গেলে তা থামানোর জন্য আসলে তাৎক্ষণিকভাবে কিছুই করার থাকে না। তবে শিশুকে নিরাপদ রাখতে কিছু কিছু কাজ করতে পারেন। যেমন-
১) সবচেয়ে জরুরী নিজেরা শান্ত থাকা এবং শান্ত রাখা। বাচ্চাকে শান্ত রাখুন। বেশির ভাগ খিঁচুনি পাঁচ মিনিটের কম স্থায়ী হয়।
২) বাচ্চাকে নরম কোন কিছুর উপর একপাশে কাত করে রাখুন কিংবা উপুড় করে রাখুন। এতে মুখ থেকে লালা বেরিয়ে যেতে পারে।
৩) বাচ্চাকে এমন নিরাপদ স্থানে রাখুন, যাতে সে পড়ে না যায় কিংবা তার শরীরে অন্য কোনো বস্তুর আঘাত না লাগে।
৪) বাচ্চার নড়াচড়ার ধরন খেয়াল করুন এবং খিঁচুনি কতক্ষণ স্থায়ী থাকে, সেটা খেয়াল করুন।
৫) খিঁচুনির সময় বাচ্চার শরীর গরম থাকলে তার কাপড়চোপড় খুলে ফেলুন এবং তাকে ঠান্ডা রাখুন।
৬) বাচ্চার নাড়াচাড়া ভালোমত খেয়াল করুন, যাতে পরবর্তীতে চিকিৎসকের কাছে গেলে ভালোভাবে বর্ননা দিতে পারেন।
৭) খিঁচুনির পর বাচ্চাকে বিশ্রামে রাখুন।
খিঁচুনির সময় যে কাজগুলো কখনওই করবেন না
বাচ্চার খিঁচুনির সময়
১) বাচ্চার দুই দাঁতের পাটির মাঝখানে জোর করে আঙ্গুল, চামচ বা অন্য কোনো বস্তু ঢোকাবেন না।
২) বাচ্চাকে ধরার চেষ্টা করবেন না কিংবা তার কাঁপা বন্ধ করার চেষ্টা করবেন না।
৩) খিঁচুনির সময় বাচ্চাকে কোনো কিছু পান করাবেন না কিংবা কোনো ওষুধ দেবেন না।
৪) খিঁচুনি থামানোর জন্য বাচ্চাকে বেঁধে রাখার চেষ্টা করবেন না।
৫) খিঁচুনি থামানোর জন্য বা শরীরের উচ্চ তাপমাত্রা কমানোর জন্য বাচ্চাকে গোসল করাবেন না।
খিঁচুনি হলে কখন যাবেন চিকিৎসকের কাছে?
১. বাচ্চার শরীর নীল হয়ে গেলে কিংবা তার খিঁচুনি পাঁচ মিনিটের বেশি স্থায়ী হলে বাচ্চাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবেন।
২. খিঁচুনি থেমে গেলেও বাচ্চার জ্ঞান না ফিরলে।
৩. খিঁচুনি থেমে যাবার পর বাচ্চা অনেক বেশি অসুস্থ আর দূর্বল দেখালে।
৪. বাচ্চার খিঁচুনির পর সব সময় ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন।
৫. যে সমস্ত বাচ্চাদের দীর্ঘক্ষন যাবত খিঁচুনি হয় তাদেরকে নিবীর পর্যবেক্ষনের জন্য হাসপাতালে নেয়াটাই ভালো। তাছারাও জ্বরটা কেনো হচ্ছে সেই কারনটাও খুঁজে বের করা দরকার।
চিকিৎসা
কনভালশন হওয়া শিশুদের জ্বর হলেই শুরুতে প্যারাসিটামল সিরাপ খাওয়াতে হবে বয়স ও ওজন অনুসারে। সেই সঙ্গে ডায়াজিপাম গ্রুপের ওষুধ পরিমাণমতো বয়স এবং ওজন অনুযায়ী খাওয়াতে হবে। তবে এসব ওষুধের কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। বর্তমানে নতুন ধরনের খিচুনিরোধক যে ওষুধ বাজারে এসেছে সেগুলো অধিকতর কার্যকরী এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও কম। এসব ওষুধ অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী খেতে হবে। যদি তিন দিনের মধ্যে জ্বর ভালো না হয় তাহলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে।
প্রথমবার কনভালশন কোন শিশুর হবে, কখন হবে আগবাড়িয়ে বলা সম্ভব নয়। কাজেই প্রথম কনভালশনের শুরুতেই শিশুকে হাসপাতালে বা ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া উচিত। পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে কনভালশনের সঠিক কারণ খুঁজে বের করে চিকিৎসা করা জরুরি। ফেব্রাইল কনভালশন জ্বরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। জ্বরকে অবহেলা না করে সঠিক সময়ে পরিমাণমতো ওষুধ খাওয়ালে এ রোগে শিশুর কোনো ক্ষতি হয় না।
অবশ্যই করণীয়
ফেব্রাইল কনভালশন বা খিঁচুনি ইনফেকশন জনিত কারণ বা উচ্চ মাত্রার জ্বরের কারণে হয়ে থাকে। অপরদিকে মৃগী রোগ একটি মেডিকেল কন্ডিশন, এটি মস্তিষ্কের একটা রোগ। মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষ থেকে বিদ্যুতের মতো হঠাৎ হঠাৎ চমকাতে থাকে। তখন শরীরে কিছু লক্ষণ প্রকাশ পায়। যেমন- ঝাঁকুনি উঠা, শরীর শক্ত হয়ে যাওয়া, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, আচরণে বিভিন্ন পরিবর্তন দেখা যাওয়া। মূলত ব্রেন-এ কিছু কেমিক্যাল-এর হটাৎ তারতম্যেই এটি হয়ে থাকে যার সাথে ফেব্রাইল কনভালশন-এর কোন সম্পর্ক নেই। ফেব্রাইল কনভালশন সাধারণত ৬ মাস থেকে ৬ বছরের বাচ্চাদেরই হয়ে থাকে, আর মৃগী রোগ যে কোন বয়সে হতে পারে। উভয় সমস্যারই উপযুক্ত কারণ এবং চিকিৎসা রয়েছে।
তাহলে বুঝলেনতো শিশুর খিঁচুনি ও মৃগী রোগের পার্থক্য! তাই অযথা আতংকিত না হয়ে খিঁচুনির কারণ জেনে সে অনুযায়ী চিকিৎসা করাতে হবে। আশা করি আপনাদের এই আর্টিকেল-টি উপকারে আসবে।
ছবি- সংগৃহীত: সাজগোজ
The post শিশুদের খিঁচুনি রোগ | মৃগী রোগের সাথে পার্থক্য ও চিকিৎসায় করণীয় কী? appeared first on Shajgoj.