অধিকাংশ নারীর জন্যই ‘মা’ হওয়া একটা অসম্ভব প্রত্যাশা, একঝাঁপি স্বপ্ন, বুকফাটা কষ্ট এরপর অনেকটুকু আনন্দের একটা জার্নি!
অনাগত সন্তানের স্বপ্নে নিজের চুল স্কিন আর হেলথ-এর ভাবনা যে কোথায় উড়ে যায়!! তার খোঁজই রাখা হয় না!!
সন্তান পৃথিবীতে আসার আগে আর পরের অসম্ভব ব্যস্ততার মাঝে হঠাৎ একদিন হয়ত আয়নায় চোখটা আটকে যায়-
“আরে! তালু এতখানি দেখা যাচ্ছে কেন? সিঁথিটাতো এতো চওড়া ছিল না আমার!!”
হতাশ হয়ে পরিবারের ফ্রেন্ড-এর হেল্প চাইলেন, ওমা তারা বলে দিল এই লাইন-
“এখন ভাববি বাচ্চার কিসে ভালো হয়, কিসে বাচ্চা সুন্দর থাকে, তা না!! নিজের চুলের চিন্তা? বাদ দে তো…বাচ্চায় কনসেনট্রেট কর!!”
সাথে সাথে মনে অপরাধবোধ চলে এল- আরে তাইতো, মা হয়ে ‘নিজের কথা’ একটু ভাবার দুঃসাহস আমার হল কিভাবে??
সন্তানের জন্মের পরের ৪-৫ মাস মেঝেতে ফ্লোরে বাথরুমে নিজের শখের গোছা চুল যখন অনাদরে পড়ে থাকতো… চুলগুলোর দিকে চেয়ে মাঝে মাঝে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা হত! কিন্তু নিজেকেই নিজে অজুহাত দিতাম-
“এখন তো আমার শিশুর কেয়ার করার সময়, একটু এদিক সেদিক হলে কি হয়?”
তো এইসব ভেবে গত এক বছরে আমার মাথার তিনভাগের একভাগ খালি হয়ে যাবার পর আমার যখন টনক নড়লো তখনও তেমন একটা লেট হয় নি… আজ আমার গত এক বছরের হেয়ারফল জার্নির কথাই বলবো… কিভাবে আমি পোস্ট পারটাম হেয়ারফল প্রিভেন্ট করে কিছু নতুন চুল গজালাম…!
বাবুর বয়স যখন ৫ মাস তখনি ডিসাইড করলাম- “আর না, সন্তানটির কেয়ার নিলে নিজের যত্ন নেয়াই যাবে না এমন রুলতো নেই কোনও”! আজ থেকেই দেখবো আর চুল পড়ে কিভাবে! এরপর শুরু হল রিসার্চ, আগে জানার ট্রাই করলাম-
কেন প্রেগনেন্সির পর হঠাৎ আমার গোছা গোছা চুল পড়ছে?
নরমাল মানুষের ডেইলি ১০০ টার মতো চুল পড়ে, কমন নলেজ। কিন্তু প্রেগনেন্সির সময়ে অনেক বেশি হেলদি খাওয়া-দাওয়া, সুস্থ লাইফস্টাইল মেইনটেইন করা আর হরমোনাল কারণে চুল অনেক কম পড়ে! মোটামুটি সুপারমডেল টাইপ সিল্কি শাইনি চুল থাকে এক্সপেক্টিং মম-দের!
শিশুর জন্মের পর আবার একটা বিশাল হরমোনাল চেইঞ্জ তৈরি হয় দেহে… দেহ নরমাল অবস্থায় ফিরে আসার জার্নি আর সাথে বাচ্চার কেয়ার নিতে গিয়ে নিজের রাতের ঘুম দিনের শান্তি নষ্ট হওয়া, দুই মিলে মাথা খালি হয়ে যেতে কয়েক মাসের বেশি কিন্তু লাগে না! এই সময়টাকে ভারিক্কি ভাষায় বলে Telogen Effluvium।
এই অবস্থায় নরমালের চেয়ে অনেক বেশি চুলের গোঁড়ার মৃত্যু হয় । প্রায় ৬০-৭০% নতুন মায়ের চুল পড়ে বেসিক্যালি এই একই কারণে।
এরপরের টেনশন… তাহলে আমার কি টাক পড়ে যাবে?
গোছা গোছা চুল ফ্লোরে পড়ে থাকতে দেখে এই ভয়েই আমার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যেত… কিন্তু না, বুঝতে পারলাম, প্রেগনেন্সির অন্যান্য উপসর্গের মতো এই অস্বাভাবিক চুল পড়াও টেম্পোরারি। টাক আমি হবো না, যদি আমি ঠিকমত রোজ নিজের কেয়ার আর চুলের কেয়ারের পেছনে একটু সময় দেই!
প্রেগনেন্সির ৩ মাস পর থেকেই বিচ্ছিরিভাবে হেয়ারফল শুরু হবার আগেই চুলের কেয়ারটা রোজ ঠিকভাবে নেয়া শুরু করা উচিত ছিল সেটা বুঝলাম… যেটা না করাটাই আমার প্রথম ভুল! কেয়ার-টা নিলে তালুটা আর ফাঁকা হত না।
বাবুর একবছর বার্থডের আগেই আমার মাথার চুল ফেরত আনতে গেলে কী কী করতে হবে সেগুলো জানাটা ছিল আমার নেক্সট রিসার্চ টপিক-
সন্তান জন্মের পর নিজের চুলের কেয়ার-টা আসলে কিভাবে নিতে হবে?
প্রথমে কিছু লাইফস্টাইল টিপস-
১) ব্লো ড্রাই, ফ্ল্যাট আয়রন বা এধরনের হিট স্টাইল একেবারেই নিষিদ্ধ নতুন মায়ের জন্য।
২) সারাদিন বাচ্চার কেয়ার নেয়ায় চুল বিরক্ত করে বলে দিনের পর দিন টাইট খোঁপা বেঁধে ফেলে রাখবেন না। মনে রাখবেন এসময়ই আপনার রুট-গুলো উইক হয়ে যাবে। টাইট করে বাঁধা খোঁপায় এই দুর্বল চুলের গোঁড়াই আরও বেশি করে উঠে চলে আসবে… চুল খুব আলগাভাবে বেণী করে রাখতে পারেন। বাট ‘নো পনিটেইল’ আর ‘নো টাইট বান’!
৩) বাচ্চাকে ব্রেস্টফিড করাতে হবে বলে বেশি খেতে হয়… তাই বলে শুধু দিনে ২-৩ প্লেট ভাত খেয়েই দায়িত্ব শেষ ভাববেন না! শুধু ভাত-রুটি-চিনি দিয়ে কতগুলো Empty Calorie না খেয়ে একটু চিন্তা ভাবনা করে সুষম খাবার খান, যাতে প্রচুর প্রোটিন, মিনারেলস, দরকারি ভিটামিনগুলো আপনি পাবেন। শাক-সবজি, বাদাম, সিজনাল ফল যেন অবশ্যই ডায়েটে থাকে!! এর Anti-oxidant আপনার চুলের গোঁড়ার জীবনটা বাড়িয়ে দেবে।
৪) আয়রন রিচ খাবার খাওয়া খুবই জরুরি– কলিজা, দুধ, ডিম, কচু, পালং শাক বেশি বেশি খেতে হবে।
উপরের কাজগুলো করার ফলে আমার অনেক অনেক হেল্প হয়েছে… আশা করি আপনাদেরও হবে।
এবারে আসি চুলের কেয়ারে কী কী ইউজ করেছি সেই পার্টে-
১) আমি চুল রোজ সকালে একবার আর রাতে একবার আঁচড়াতাম।
২) সপ্তাহে ৩ বার (মানে একদিন বাদ দিয়ে দিয়ে) পিওর নারিকেল তেল দিয়ে খুব ভালোভাবে স্ক্যাল্প-টা ম্যাসাজ করতাম। যাতে অবহেলায় তৈরি হওয়া খুশকি গুলো আলগা হয়ে যায় আর তেলটা একদম প্রতিটা চুলের গোঁড়ায় গোঁড়ায় পৌঁছে যায়… জাস্ট ১৫ মিঃ ম্যাসাজ করে চুলটা উল্টে আঁচড়াতাম, মানে চুলগুলো সামনে এনে ঘাড় থেকে শুরু করে কপালের দিকে চিরুনি চালাতাম… এতে অয়েল ম্যাসাজের ব্লাড সার্কুলেশন-টা বেড়ে যায়। আমি ব্যবহার করেছি প্যারাসুট কোকোনাট অয়েল। তেলটা দারুণ এবং আসলেই খাঁটি।
৩) সারারাত নারিকেল তেলটা মাথায় রাখতে হবে। প্যারাসুট কোকোনাট অয়েল-এর সবচেয়ে ভালো দিক- চুলের গ্রোথ বাড়াবে আর গোঁড়াটা শক্তও করবে। এতে চুল পড়া যেমন কমে যাবে আস্তে আস্তে নতুন চুল গজাবেও… জাস্ট আমাকে struggle করতে হয়েছে রেগুলারিটি মেইনটেইন করতে গিয়ে…! সারাদিন বাচ্চার পিছনে সময় দিয়ে রাতে আর হাত চলত না… মনে হত তেল ফেলে দিয়ে কি হবে? ঘুমাই একটু বরং… কিন্তু যখন অয়েল ম্যাসাজ করার ১ মাসের ভেতরে হেয়ারফল দিনে ৮০-১০০ টা থেকে মাত্র ২৫-৩০ টায় নেমে এলো, এরপর আমি আর চুলে তেল ম্যাসাজে আলসেমি করিনি!!!
৪) পরদিন সকালে খুব ভালোভাবে চুলটা শ্যাম্পু করে এয়ারড্রাই করে শুকিয়ে নিতাম।
৫) ব্যস, এটুকুই… ঠিকভাবে খাওয়া, চুলে সঠিকভাবে অয়েল ম্যাসাজ আর শ্যাম্পু করা। আমি বাচ্চার বয়স ৮ মাস হওয়ার আগে চুলে একটা দিনও কোনও মাস্ক বা কিছু এক্সট্রা মাখার টাইম-ই পাই নি! কিন্তু তারপরেও আস্তে আস্তে আমার হেয়ারফল অনেকখানি কমে গেছে!
এখন বাবুর বয়স ১০ মাস, এখন রোজ গুনে দেখি আমার ১০-২০ টার মতো চুল পড়ছে। আর গত ২ মাসে স্ক্যাল্প-এ ছোটছোট অনেক বেবি হেয়ার গ্রো করেছে… ওগুলো তেল দিয়ে ঠিকভাবে বড় করাটাই এখন আমার টার্গেট।
আশা করি আবার কিছুদিনের মধ্যে চুলের আগের ঘনত্ব ফিরে পাবো… থ্যাঙ্ক গড, হাল ছেড়ে না দিয়ে সময়মত একটু কেয়ার করেছিলাম! নইলে এতদিনে হয়ত শখের চুলগুলো কেটেই ফেলতে হত!!
এইতো, এটাই আমার স্টোরি, হোপফুলি কেউ কেউ একটু হলেও আশার আলো দেখতে পেলেন। প্লিজ হতাশ হবেন না। বাচ্চার কেয়ার নেয়ার পাশাপাশি নিজের কেয়ারটাও করা জরুরি। এটা ভুলে যাবেন না। আর কেয়ার করতে গেলে সারাদিনই আয়নার সামনে বসে থাকার দরকার হয় না। সপ্তাহে জাস্ট কয়েকটা ঘণ্টাও কি নিজের জন্য দেবেন না?
একটু ভেবে দেখুন!
ছবি- ইমেজেসবাজার.কম, পিন্টারেস্ট.কম