বহুমূত্র রোগ বা ডায়াবেটিস মেলিটাস (ইংরেজিতে Diabetes mellitus) একটি হরমোন সংশ্লিষ্ট রোগ। দেহে অগ্ন্যাশয় যদি যথেষ্ট ইনসুলিন তৈরি করতে না পারে অথবা শরীর যদি উৎপন্ন ইনসুলিন ব্যবহারে ব্যর্থ হয়, তাহলে যে রোগ হয় তা হলো ‘ডায়াবেটিস’ বা ‘বহুমূত্র রোগ’। তখন রক্তে চিনি বা শর্করার অতিরিক্ত উপস্থিতির কারণে কিছু অসামঞ্জস্যতা দেখা দেয় যেমন- ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া, বার বার ক্ষুধা পাওয়া, অতিরিক্ত পিপাসা ইত্যাদি। ইনসুলিনের ঘাটতিই হল এ রোগের মূল কথা। ইনসুলিন হল অগ্ন্যাশয় থেকে নিঃসৃত হরমোন, যার সহায়তায় দেহের কোষগুলো রক্ত থেকে গ্লুকোজকে নিতে সমর্থ হয় এবং একে শক্তির জন্য ব্যবহার করতে পারে। ইনসুলিন উৎপাদন বা ইনসুলিনের কাজ করার ক্ষমতা-এর যেকোনো একটি বা দুটোই যদি না হয়, তাহলে রক্তে বাড়তে থাকে গ্লুকোজ। আর একে নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে ঘটে নানা রকম জটিলতা, দেহের টিস্যু ও বিভিন্ন অঙ্গ বিকল হতে থাকে।
কয় ধরনের হয়
১. টাইপ ১
এ রোগে অগ্ন্যাশয়ের ইনসুলিন নিঃসরণকারী কোষগুলো ধ্বংস হয়ে যায়। তাই যাদের টাইপ-১ হয়, এদের দেহে ইনসুলিন উৎপাদিত হয় খুবই কম। এ জন্য রোগীকে বেঁচে থাকার জন্য ইনসুলিন ইনজেকশন বা ইনসুলিন পাম্প নিতে হয়। শিশু ও তরুণদের মধ্যে এ ধরনের বহুমূত্র হয় বেশি।
২. টাইপ ২
সাধারনত ৯০% মানুষ টাইপ-২ ডায়াবেটিস-এ আক্রান্ত। এক্ষেত্রে অগ্ন্যাশয়ের কোষগুলো ইনসুলিন নিঃসরণ করে ঠিকই তবে সেগুলো ঠিকভাবে কাজ করতে পারে না,অর্থাৎ শরীরের গ্লুকোজগুলোকে এনার্জিতে রুপান্তরিত করতে পারে না। যার ফলে শরীরে গ্লুকোজের পরিমাণ দিন দিন বাড়তে থাকে। একে বলা হয় ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স। সাধারণত ৪০ বছর বা তার পরে এ রোগ দেখা দেয়।
৩. অন্যান্য
গর্ভাবস্থায় নারীদের এক প্রকার ডায়েবেটিস হয় যাকে জেস্টেশনাল ডায়াবেটিস-ও বলা হয়। গর্ভকালীন ডায়াবেটিস মা ও শিশু দু’জনেরই ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। ডায়াবেটিস সুনিয়ন্ত্রিত না থাকলে গর্ভপাত, গর্ভে শিশুর মৃত্যু, শিশুর জন্মগত ত্রুটি, শিশুর অতিরিক্ত ওজন, শিশু মৃত্যু এবং জন্মপরবর্তী শিশুর বিভিন্ন রকম জটিলতা দেখা দেয়। পরবর্তীতে জীবনে সে শিশুর ডায়াবেটিস হবার সম্ভাবনা অন্যদের চাইতে বেশী থাকে।
দেহে গ্লুকোজের সঠিক মাত্রা
সুস্থ স্বাভাবিক অবস্থায় রক্তের প্লাজমায় গ্লুকোজের পরিমাণ অভুক্ত অবস্থায় (অন্তত ১২ ঘণ্টা) ৬.১ মিলি মোলের কম এবং খাবার ২ ঘণ্টা পরে ৭.৮ মিলি মোলের কম অথবা ৭৫ গ্রাম গ্লুকোজ খাওয়ার ২ ঘণ্টা পরে রক্তের প্লাজমায় গ্লুকোজের পরিমাণ ১১.১ মিলিমোলের কম থাকে। এর বেশি হলেই কোন ব্যক্তির ডায়াবেটিস আছে বলে নিশ্চিত হওয়া যায়।
সাধারণ লক্ষণ
- ঘন ঘন ক্ষুধা পাওয়া
- অল্প কাজ করেই ক্লান্ত হয়ে যাওয়া
- শরীরে এনার্জির অভাব বোধ করা
- প্রচুর পরিমাণে এবং ঘন ঘন পানির পিপাসা পাওয়া
- ঘন ঘন প্রস্রাবের বেগ হওয়া
- হঠাৎ করে ওজন খুব বেড়ে যাওয়া বা খুব কমে যাওয়া
- চোখের ঝাপসা দেখা।
- জিভ শুকিয়ে যাওয়া
- গা চুলকানো
- কেটে যাওয়া ক্ষত শুকোতে বেশি সময় নেয়া
কারণসমুহ
যে কেউ যে কোনো বয়সে যেকোনো সময় ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতে পারেন। তবে নিম্নোক্ত শ্রেণীর ব্যক্তিদের মধ্যে ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে-
- যাদের বংশে বিশেষ করে বাবা-মা বা রক্ত সম্পর্কিত নিকটাত্মীয়ের ডায়াবেটিস আছে।
- যাদের ওজন অনেক বেশি ও যারা ব্যায়াম বা শারীরিক পরিশ্রমের কোনো কাজ করেন না।
- যারা বহুদিন ধরে কর্টিসোল জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করেন।
- যেসব মহিলার গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস ছিল, বা যাদের পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রম থাকে।
- যাদের রক্তচাপ আছে এবং রক্তে কোলেস্টেরল বেশি থাকে।
ডায়াবেটিস-সংক্রান্ত জটিলতা
ডায়াবেটিস এর কারণে ধীরে ধীরে দেহে বিভিন্নরকম জটিলতা দেখা দেয়, যত দীর্ঘ সময় ধরে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ অনিয়ন্ত্রিত থাকে জটিলতা তত বাড়তে থাকে। যা কখনো কখনো মৃত্যুর কারণও হয়ে দাঁড়ায়। তার মধ্যে হৃদরোগ, স্নায়ুরোগ, কিডনিজনিত সমস্যা বা কিডনি ফেইলিওর, চোখের রেটিনা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া এবং তা থেকে অন্ধত্ব ইত্যাদি সমস্যা অন্যতম। এছাড়াও ডায়েবেটিক ফুট বা পায়ের আলসার ও ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য আরেক আতংক, এর ফলে অনেক সময় রোগীর পাও কেটে ফেলতে হতে পারে। চর্মরোগ, শ্রবণজনিত সমস্যা, বিষন্নতা ইত্যাদিও হতে পারে। রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ হুট করে কমে গেলেও বিপদ হতে পারে। অতিরিক্ত ঘাম, মাথা ঘোরা, চোখে ঘোলাটে দৃষ্টি, খিঁচুনি এমনকি এ থেকে অনেক সময় মৃত্যু পর্যন্ত ডেকে আনতে পারে যদি সঠিক সময়ের মধ্যে তা ঠিক না করা হয়।
চিকিৎসা
কোন ধরনের ডায়াবেটিস তার উপর নির্ভর করে নিয়মিত রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নির্ণয়, মুখে খাওয়ার ঔষধ, ইনসুলিন ইত্যাদি মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। ডায়েট মেনে চলা এবং নিয়মিত হাঁটা বা ব্যায়াম করা ডায়াবেটিস চিকিৎসার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
খাদ্য তালিকায় বেশি বেশি আঁশযুক্ত খাবার যুক্ত করা এবং চিনি ও মিষ্টি জাতীয় খাবার ত্যাগ করা জরুরী। প্রতিবেলায় একবারে বেশি করে না খেয়ে বারে বারে অল্প করে খাওয়ার অভ্যাস করতে ডায়াবেটিস রোগীদের পরামর্শ দেয়া হয়ে থাকে।
প্রতিরোধ
- ডায়াবেটিস প্রতিরোধ-এর ক্ষেত্রে কিছু টিপস মনে রাখা জরুরী-
- কায়িক শ্রম ও নিয়মিত হাঁটা বা ব্যায়াম করা যা ওজন ও রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে।
- খাদ্য তালিকায় বেশি বেশি আঁশযুক্ত খাবার রাখা যেমন ফলমূল, শাকসবজি ইত্যাদি ।
- শস্যদানা যেমন গম, ভুট্টা, বার্লি ইত্যাদি বা এসব থেকে তৈরি খাবার যেমন ব্রেড বা পাস্তাজাতীয় খাবার রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
- ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা। এটি শুধু ডায়াবেটিস নয়, অন্য আরো অনেক ধরনের রোগ যেমন- হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, নিদ্রাহীনতা, আরথ্রাইটিস ইত্যাদি প্রতিরোধে সাহায্য করে।
- খাদ্য তালিকা থেকে শর্করা ও চর্বি জাতীয় খাবার বাদ দেয়া বা খুবি অল্প পরিমাণে রাখা।
এগুলো মেনে চলা ছাড়াও যাদের পরিবারে বা রক্তের সম্পর্ক আছে এমন আত্মীয়দের মাঝে ডায়াবেটিস আছে তারা ৪৫ বছর বয়সের পর নিয়মিত ডাক্তারের পরামর্শে ডায়াবেটিস পরীক্ষা করাতে পারেন। এছাড়াও ৪৫ বছর বয়সের আগেও যদি অতিরিক্ত ওজন থাকে তবে সেই ব্যক্তিও পরীক্ষা করাতে পারেন।
বর্তমান সময়ে ডায়াবেটিস পুরো বিশ্বের ঘরে ঘরে অনেকটাই যেন মহামারি আকার ধারণ করেছে, এর থেকে প্রতিকার ও সচেতনতা গড়ে তুলতে এই বিষয়ে শিক্ষা ও জীবনযাত্রার কিছু পরিবর্তন এখন সময়ের দাবি।
লিখেছেন- ডাঃ মারুফা আক্তার