স্তন ক্যান্সার পৃথিবীজুড়ে মেয়েদের সবচেয়ে বড় ঘাতকের নাম। প্রতি বছর সারা পৃথিবী জুড়ে প্রায় দেড় থেকে দুই মিলিওন (১৫-২০ লক্ষ!) নতুন স্তন ক্যান্সারের রোগী পাওয়া যায়, যার মধ্যে ৫-৭ লাখ মারা যায় স্তন ক্যান্সারের কারণে। তবে এই রোগটি নিয়ে সচেতনতার পাশাপাশি অনেক অহেতুক ভীতিও ছড়ানো হচ্ছে। গত কয়েকদিন ধরে বিভিন্ন জায়গায় “সূত্র: ইন্টারনেট” থেকে যে যা পারছে তুলে দেয়া হচ্ছে। যা আসলেই খুব দুঃখজনক। এবং অনেক জায়গায় দেখলাম নিজে নিজে স্তন ক্যান্সার নির্ণয়ে সুবিধার জন্য রেগুলার সেলফ এক্সামের উপর জোর দিচ্ছে।
অক্টোবর স্তন ক্যান্সার সচেতনতার মাস। সাজগজের সব সময়ই প্রয়াস থাকে তার বন্ধুদের সঠিক এবং বিশ্বস্ত তথ্যটি পৌঁছে দিতে। স্তন ক্যান্সার গবেষক, ক্যালগেরিতে পি,এইচ,ডি প্রাপ্ত শান্তনু বণিক এই রোগ নিয়ে তার গবেষণা থেকে পাওয়া তথ্য এবং স্তন ক্যান্সার নিয়ে ভ্রান্তিমূলক ধারণাগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। চলুন বিশেষজ্ঞ শান্তনু বণিকের দৃষ্টিকোণ থেকে আজ আমরা জানব, স্তন ক্যান্সার কেন হয়? এর রকমফের এবং নির্ণয়ের উপায় সম্পর্কে।
স্তন ক্যান্সার কেন হয়?
ক্যান্সার কেন হয় এর অনেকগুলো জানা কারণ আছে, তেমনি অনেক অজানা কারণও আছে। কিছুদিন আগে কিছু গবেষক বলেছিলেন, ক্যান্সার কোন কোন ক্ষেত্রে জাস্ট ব্যাড লাক, যেকারোই হতে পারে। যেকোন ক্যান্সারের জন্য একটা কোষের মিউটেশনই দায়ী হতে পারে। সরল ভাষায়, ক্যান্সার হচ্ছে যখন শরীরের কিছু কোষ আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিয়ে বা পরাজিত করে অস্বাভাবিক আচরণ করতে শুরু করে এবং অস্বাভাবিকভাবে ছড়াতে/বাড়তে থাকে।
এই অস্বাভাবিক কোষ যখন মূল উৎপত্তি স্থল থেকে (টিস্যু বা অঙ্গ) দেহের নানা জায়গায় ছড়াতে শুরু করে তখন তাকে বলা হয় মেটাস্টাসিস (এটাই মূলত মৃত্যুর জন্য দায়ী)। আর কোথায় উৎপত্তি হয়েছে সেটাও আরেকটা বড় ফ্যাক্টর (যেমন সাধারণ ত্বকের ক্যান্সার হলে মারা যাবেন না হয়তো, কিন্তু সেটা যদি অন্য জায়গায়/ভাইটাল অর্গানে ছড়িয়ে পড়ে তাহলে মৃত্যুর সম্ভাবনা অনেক বেশি।) ব্রেস্ট ক্যান্সারের পিছনের রিস্ক ফ্যাক্টরগুলো দুই রকম, কিছু ফ্যাক্টর আমরা দূর করতে পারি, কিছু ফ্যাক্টর আমাদের বা কারোই কিছু করার নেই।
মেয়েদের স্তন ক্যান্সারের রিস্ক বেশি। এরপর আসবে অতিরিক্ত মোটা হওয়া (বিশেষত পেটের চর্বি), অস্বাস্থ্যকর/অনিয়মিত জীবন-যাপন, ধূমপান, মদ খাওয়া, নিয়মিত ফিজিক্যাল এক্টিভিটি বা শারীরিক পরিশ্রম না করা, রেডিয়েশন; অল্প বয়সে অতিরিক্ত এক্সরে করানো, সিটি স্ক্যান করানো, রেডিয়েশন বের হয় এমন কিছুর আশেপাশে থাকা, পৃথিবীর যেসব জায়গায় নানা কারণে রেডিয়েশন বেশি (প্রাকৃতিক বা মানবসৃষ্ট- নর্থ আমেরিকার কিছু জায়গায় যেমন রেডিয়েশন বেশি) সেসব জায়গায় থাকা, অপুষ্টি ইত্যাদি।
অন্যান্য কারণের (পরিবর্তন যোগ্য বা পরিবর্তন সম্ভব নয় এমন) মাঝে আছে,
- অনেক বেশি বয়সে বাচ্চা নেয়া (৩০ এর পর প্রথম সন্তান ধারণ) বা একেবারেই না নেয়া, ব্রেস্ট ফিডিং না করানো, হরমোন থেরাপি, খুব অল্প বয়সে মাসিক/পিরিয়ড হওয়া (১১/১২ বছরের আগে) , অনেক দেরীতে মেনোপজ হওয়া (~৫৫) , এবং বংশগত কারণ।
- নিকটাত্মীয়ের মধ্যে (মা-বাবা দুই দিকেই) কারো হয়ে থাকলে তাদের হবার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে। কারো শরীরে BRCA1/BRCA2/p53 মিউটেটেড জীনের অস্তিত্ব থাকলে তাদেরকে অনেক বেশি রিস্কে আছে বলে ধরা হয়। আর বয়সের সাথে সাথে রিস্কও বাড়তে থাকে (খুব সম্ভব বেশিরভাগ ক্যান্সারের জন্যই সত্য)।
- সাম্প্রতিক কালে শরীরে “ভিটামিন ডি”-এর স্বল্পতার সাথেও ব্রেস্ট ক্যান্সার এর লিংক পাবার সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা হচ্ছে এবং সেই সম্ভাবনাও কম না।
- শরীরে মেদের পরিমাণের উপরও নির্ভর করে রিস্ক। উর্ধাঙ্গে বা পেটের মেদ থাকলে সেটা একটা রিস্ক ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়ায় মেনোপজের পরে মহিলাদের জন্য। সাধারণত, মেনোপজের আগে শরীরের ফ্যাট ব্রেস্ট ক্যান্সারের বিরুদ্ধে কিছুটা প্রতিরক্ষামূলক কাজ করতে পারে। কিন্তু মেনোপজের পর ঘটনা উলটে যায়, শরীর আর এস্ট্রোজেন (মেয়েদের হরমোন) তেমন তৈরি করে না, শরীরের ফ্যাট সেটা সাপ্লাই দেয়া শুরু করে, যেটা ওই বয়সে কোনভাবে ক্যান্সারকে ট্রিগার করতে পারে।
- জন্মবিরতিকরণ পিল অনেক বছর ধরে ব্যবহার করলে ব্রেস্ট ক্যান্সারের রিস্ক বাড়ে। তবে বন্ধ করে দেয়ার পর আস্তে আস্তে এর এফেক্ট কমতে থাকে। লং টার্মের জন্মবিরতিকরণ পদ্ধতি/ হরমোন ইনজেকশন নিলে এই রিস্ক বাড়ে (অনেক রোগেরই রিস্ক বাড়ে, সেজন্য মেয়েদের শরীর ধ্বংসকারী পিলের চেয়ে সম্পূর্ণ নিরাপদ কনডম ব্যবহার উৎসাহিত করা জরুরি )।
- আরেকটা মোটাদাগের ফ্যাক্টর হচ্ছে, এথনিসিটি/জাতিসত্ত্বা – যেমন আফ্রিকানদের (কালো) ব্রেস্ট ক্যান্সার কম হয়, ককেশিয়ান (সাদা) দের বেশি হতে পারে – বিবর্তন গত কারণ ছাড়াও পরিবেশগত কারণ রয়েছে। এলকোহলের ব্যবহার আরেকটা কারণ। এদিকে আফ্রিকানদের কম হলেও, তাদের ক্ষেত্রে স্তন ক্যান্সার খুব দ্রুত শরীরে ছড়িয়ে পড়ে এবং মৃত্যুহার বেশি হয়। এশিয়ানদের এবং সাউথ এশিয়ানদের তুলনামূলক কম হয়।
স্তন ক্যান্সারের রকমফের ও স্টেজিং দেশের স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত কারো আত্মীয়-বন্ধু যখন বলে অমুকের ক্যান্সার ধরা পড়েছে, স্টেজ-III বা স্টেজ-IV, কিন্তু এই স্টেজিং কীভাবে করা হয়?
স্টেজিং করা হয় অনেকগুলো ফ্যাক্টর বিবেচনা করে, প্রাইমারি লোকেশন, বিনাইন না ম্যালিগন্যান্ট, লসিকা গ্রন্থি (লিম্ফ নোড, আমাদের শরীরের ইমিউনিটি/রোগ প্রতিরোধকারী ব্যবস্থার অংশ) আক্রান্ত কি না, সাইজ, গ্রেড, মেটাস্টাসাইজ হয়েছে কি না ইত্যাদি। আর ক্যান্সার ধরা পড়ার পর চিকিৎসা করলে ভাল হবে কি না বা কতদিন বাঁচবে এটা নির্ভর করে চিকিৎসার কার্যকারিতা, সাইজ, গ্রেড, বয়স, বৃদ্ধির হার, এবং ব্যক্তির উপর। আপাতত ৫ বছরের “রিলেটিভ সারভাইভাল রেট” বিবেচনায় মোটা দাগে উন্নত বিশ্বে বিষয়টা এরকম – (মানে এরকম ১০০ জনের মধ্যে কতজন ৫ বছর বাঁচবেন (গড়ে), এটা ১০ বছর বা ১৫ বছর হিসাবে নেয়া যায়, তখন ক্যান্সার আবারো ফিরে আসার সুযোগ থাকে এবং রেটটা তখন কমে যায়)
স্টেজ ০
ক্যান্সার না, বা ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়ার কোন লক্ষণ ধরা পড়েনি। ৫ বছর বাঁচার হার ১০০%
স্টেজ ১:
১-A – ২ সেমির চেয়ে ছোট টিউমার, ছড়িয়ে পড়ছে না। ১-B খুব ছোট টিউমার থাকতে পারে নাও পারে, কিন্তু খুব ছোট ছোট একাধিক ক্যান্সার কোষ পাওয়া গেছে। লসিকা গ্রন্থিতে থাকতে পারে নাও পারে। ৫ বছর বাঁচার হার ১০০%
স্টেজ ২:
A এবং B ভাগ আছে। মোটা দাগে, টিউমার ৫ সেমি পর্যন্ত হতে পারে, ছোট ছোট একাধিক ক্যান্সার কোষ আছে (২মিমির নিচে), এবং/অথবা ৩টির মত লসিকা গ্রন্থিতে ছড়িয়ে পড়ছে। ৫ বছর বাঁচার হার ৯৩%
স্টেজ ৩:
A , B এবং C ভাগ আছে। ভয়াবহতার শুরু। কোন রকম লক্ষণ থাকতেও পারে নাও পারে। লাল হয়ে বা ফুলে উঠতে পারে স্তন, স্তনে গরম অনুভূত হতে পারে, বগলের নিচে ব্যথা হতে পারে, চামড়ায় চিহ্ন দেখা যেতে পারে। ক্যান্সার বড় হয়েছে, ১০ টির বেশি গ্রন্থিতে ছড়িয়ে পড়েছে, ৫ সেমির বড় টিউমার বা যেকোন আকার-আকৃতির ক্যান্সার থাকতে পারে, বুকের পেশী ও দেয়ালে ছড়িয়ে পড়তে পারে। ৫ বছর বাঁচার হার ৭২%
স্টেজ ৪:
ক্যান্সার লসিকা গ্রন্থি ও রক্তের মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে- মেটাস্টাসিস চামড়া, হাড়, মস্তিষ্ক, ফুসফুস, লিভার, কিডনি, বা রক্তে ছড়িয়ে পড়েছে। ৫ বছর বাঁচার হার ২২% (খুব ভাল চিকিৎসা হলে এবং চিকিৎসায় ফল পাওয়া গেলে)
আশার কথা এই যে দিন দিন স্তন ক্যান্সার যত দ্রুত সম্ভব ধরার জন্য প্রচুর গবেষণা হচ্ছে এবং বর্তমানে খুব দ্রুতই ধরা পড়ছে, একই সাথে চিকিৎসা ব্যবস্থাও দিন দিন উন্নত হচ্ছে। যেকারণে আক্রান্তের হার বাড়তে থাকলেও মৃত্যুহার আস্তে আস্তে কমে আসছে।
নির্ণয়ের উপায়?
স্তন ক্যান্সারকে একরকমের নীরব ঘাতকই বলা যায়। যতক্ষণে টের পাওয়া যায় ততক্ষণে অনেক ক্ষেত্রেই দেরি হয়ে গিয়েছে। স্তন ক্যান্সার ধরার পড়ে সাধারণত তিন ভাবে।
(১) উন্নত বিশ্বে ৪৫ বা ৪৯ বছর বয়স থেকে প্রতি ১-২ বছর পর পর নিয়মিতভাবে ম্যামোগ্রাম করা হয়। একে বলা হয় স্ক্রিনিং প্রোগ্রাম। সাধারণত ৬৯ বছর বয়স পর্যন্ত এটা করা হয়ে থাকে। এরপর সাধারণত ক্যান্সারের বৃদ্ধি খুব আস্তে হয় আর চিকিৎসাও কিছুটা ভিন্ন রকমের হয়। যাদের রিস্ক অনেক বেশি তাদেরকে ৪০ এর পর থেকেই অনেক সময় নিয়মিত ম্যামোগ্রাফি করতে বলা হয়। স্ত্রিনিং প্রোগ্রামের ম্যামোগ্রামগুলো অন্তত দুইজন রেডিওলজিস্ট স্বাধীনভাবে চেক করেন, একই সাথে কিছু কম্পিউটার সফটওয়ারও ব্যবহৃত হয় অটোমেটিক ভাবে সন্দেহজনক জায়গাগুলোতে রেডিওলজিস্টকে এবার চেক করতে বলার জন্য।
(২) কেউ কোন কারণে অসুস্থ বোধ করলে, তার অন্য কিছু স্ক্রিনিং করতে গিয়ে (এম,আর,আই; সিটি স্ক্যান; এক্সরে; আল্ট্রাসাউন্ড) বা ডাক্তারের কাছে ক্লিনিক্যাল এক্সামের জন্য গেলে তখন ধরা পড়ে।
(৩) সেলফ এক্সামের সময়। দুর্ভাগ্যবশত স্ক্রিনিং এর বাইরে ধরা পড়া টিউমারের প্রায় ৮০ ভাগই ধরা পড়ে এভাবে। সেলফ এক্সাম ও ক্লিনিক্যাল এক্সামের কার্যকারিতা নিয়ে বলছি এবার।
(চলবে…)
লিখেছেন - শান্তনু বণিক, পি,এইচ,ডি (প্রাক্তন)
স্তন ক্যান্সার গবেষক, ক্যালগেরি
বিশেষজ্ঞের দৃষ্টিকোণ থেকে স্তন ক্যান্সার: কিছু ভ্রান্তিমূলক ধারণা (পর্ব ০১)