অজ্ঞান করার ব্যাপার নিয়ে সবার মধ্যেই কমবেশি ভয় কাজ করে। আধুনিক শল্য চিকিৎসায় অ্যানেস্থেসিয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অ্যানেস্থেসিয়ার মাধ্যমে অনেক জটিল অপারেশন অস্বস্তি বা ব্যথা মুক্তভাবে করা সম্ভব হয়। অপারেশনের ধরন, শরীরে অপারেশনের জায়গা, এমনকি রোগীর ফিজিক্যাল কন্ডিশন ছাড়াও আরও অনেক কারণের উপর ভিত্তি করে অ্যানেস্থেসিয়ার ধরন পরিবর্তন হয়। বর্তমানে নানা ঘটনার কারণে অনেকের মনেই এই অ্যানেস্থেসিয়া নিয়ে কিছু দ্বিধার সৃষ্টি হয়েছে। আজকের লেখার মাধ্যমে তাই অ্যানেস্থেসিয়া বা অজ্ঞান করার ব্যাপার নিয়ে ভীতি দূর করার চেষ্টা করবো।
অ্যানেস্থেসিয়া কী?
অ্যানেস্থেসিয়া হচ্ছে নিয়ন্ত্রিতভাবে সংবেদনশীলতা ও চেতনা হ্রাস করার পদ্ধতি। এর ফলে সাময়িক সময়ের জন্য ব্যথা, এমনকি অপারেশনের সময়কার স্মৃতিও ভুলিয়ে দেওয়া যায়। অ্যানেস্থেসিয়ার মাধ্যমে ছোট বড় নানা রকমের অপারেশন কম জটিলতায় বা জটিলতাবিহীন ভাবে করা সম্ভব হয়। তবে এ কাজের জন্য অবশ্যই আলাদাভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসকের প্রয়োজন। অ্যানেস্থেসিয়ায় পারদর্শী চিকিৎসকদের অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট বলা হয়।
অ্যানেস্থেসিয়ার প্রকারভেদ
১) লোকাল অ্যানেস্থেসিয়া-
লোকাল অ্যানেস্থেসিয়া শরীরের কোনো ছোট ও নির্দিষ্ট জায়গাকে খুবই সীমিত সময়ের জন্য ( অন্তত পক্ষে ৩০ মিনিট ) অসাড় করতে ব্যবহার করা হয়। এটি সাধারণত ছোটখাটো কোনো সেলাই, চামড়া বা দেহের ছোট বর্ধিত অংশ কর্তনের জন্য, অথবা ছোটখাটো কাটাছেড়া জোড়া দিতে ব্যবহার করা হয়।
এটি খুবই কম জায়গা জুড়ে প্রভাব বিস্তার করে এবং তুলনামূলক নিরাপদ। সাইড ইফেক্ট তুলনামূলকভাবে কম এবং অ্যানেস্থেসিয়া দেওয়ার খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সেই জায়গার সংবেদনশীলতা ফেরত আসে। লোকাল অ্যানেস্থেসিয়া বা অজ্ঞান করার পদ্ধতির সুবিধার পাশাপাশি কিছু অসুবিধাও আছে। বিরল হলেও কিছু কিছু প্রতিক্রিয়া দেখা যায়, যেমন প্রয়োগের স্থানে অ্যালার্জিক রিয়েকশন হতে পারে, অথবা অদক্ষ হাতে প্রয়োগের ফলে স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। অবশ করার স্থায়িত্বকাল সীমিত বিধায় অতিরিক্ত ডোজের প্রয়োজন হতে পারে।
২) রিজিওনাল বা নার্ভ ব্লক অ্যানেস্থেসিয়া-
রিজিওনাল বা নার্ভ ব্লক অ্যানেস্থেসিয়া শরীরের কোনো নির্দিষ্ট অঙ্গ বা অঙ্গের কোনো অংশে সংবেদনশীলতা অসাড় করতে ব্যবহার করা হয়। যেমন হাত, পা বা শরীরের নিচের অর্ধেক অংশ। এটি সাধারণত জয়েন্ট রিপ্লেসমেন্ট, নরমাল ডেলিভারির সময় (এপিডুরাল অ্যানেস্থেসিয়া), বা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে অস্ত্রপচারের মতো পদ্ধতির জন্য ব্যবহৃত হয়।
এর সুবিধা হচ্ছে এই অ্যানেস্থেসিয়ায় রোগী সজাগ থাকে, নিজে নিজে শ্বাস নিতে পারে, এমনকি অপারেশন চলাকালীন সময়ে কথাও বলতে পারে। জেনারেল অ্যানেস্থেসিয়ায় সাধারণত যে সমস্ত ঝুঁকি থাকে তা রিজিওনাল অ্যানেস্থেসিয়ায় থাকে না। এই অ্যানেস্থেসিয়ার ফলে অপারেশন চলাকালীন সময় এবং পরবর্তীতে ব্যথা কম অনুভূত হয় এবং অতি উচ্চ মাত্রার ব্যথার ঔষধ ব্যবহারের প্রয়োজন হয় না। রিজিওনাল অ্যানেস্থেসিয়ার পার্শপ্রতিক্রিয়া হিসেবে নার্ভ ইনজুরি, রক্তপাত বা ইনজেকশন সাইটে ইনফেকশন হতে পারে। অসাবধানতাবশত শরীরের অন্যান্য অংশ প্রভাবিত হওয়ার ঝুঁকিও থাকে।
৩) জেনারেল অ্যানেস্থেসিয়া-
জেনারেল অ্যানেস্থেসিয়া সাধারণত জটিল ও বড় ধরনের অপারেশনের জন্য করা হয় যেখানে রোগীকে একদম চেতনা বিহীন করা হয় এবং রোগী অপারেশন চলাকালীন সময়ের কোনো স্মৃতিই মনে করতে পারে না। পেট, বুক বা ব্রেণ এর অপারেশনে সাধারণত জেনারেল অ্যানেস্থেসিয়া দেয়া হয়। তবে শিশুদের ক্ষেত্রে কিছু কিছু ছোট অপারেশনের বেলাতেও জেনারেল অ্যানেস্থেসিয়া দেয়া লাগতে পারে। এ ক্ষেত্রে চেতনা-নাশের জন্য ব্রিদিং টিউব অথবা মাস্কের সাহায্যে অজ্ঞান করার গ্যাস ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়াও পেশী শিথিল করতে, ঘুম আনাতে এবং ব্যথা কমাতে শিরা পথেও কিছুব ঔষধ দেয়া হয়ে থাকে।
অনেক রকম সুবিধার পাশাপাশি জেনারেল অ্যানেস্থেসিয়ার কিছু জটিলতাও আছে। চেতনা ফিরে আসার পর বমি বমি ভাব বা বমি, বিভ্রান্তি, শ্বাসকষ্ট এমনকি অ্যানেস্থেসিয়ার মেডিসিনে অ্যালার্জিক রিয়েকশন হতেও দেখা যায়।
জেনে রাখা ভালো
যে কোনো ধরনের অ্যানেস্থেসিয়ার পূর্বে কিছু সাধারণ কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানা থাকলে ছোট বড় দূর্ঘটনা এড়িয়ে চলা যায়।
মেডিক্যাল হিস্ট্রি
যে কোনো ধরনের অপারেশন বা অ্যানেস্থেসিয়ার আগে চিকিৎসককে পূর্ব থেকে থাকা শারীরিক যে কোনো অসুখ, হার্টের সমস্যা, অ্যালার্জি বা নিয়মিত সেবন করা ঔষধের তথ্য দিতে হবে। যার জন্য প্রিঅ্যানেস্থেটিক চেকআপ করা অবশ্যই প্রয়োজন।
পেট খালি রাখা
অপারেশন, অ্যানেস্থেসিয়ার ধরন অনুযায়ী অপারেশন থেকে ৪ থেকে ১২ ঘন্টা আগে থেকে সম্পূর্ণভাবে না খেয়ে থাকার পরামর্শ দেন চিকিৎসক। কারণ পেটে খাবার এমনকি সামান্য পানি থাকলেও অ্যানেস্থেসিয়ার কারণে মাংসপেশী শিথিল হয়ে পাকস্থলির খাবার উপরে উঠে এসে শ্বাসনালীতে চলে যেতে পারে। যার ফলে ঘটে যেতে পারে মারাত্মক দূর্ঘটনা। অজ্ঞান করার কারণে শরীরের ভেতরের অঙ্গ কিছুটা নাজুক হয়ে পড়ে, তখন পেটে কিছু থাকলে বমির ঝুঁকি থাকে। এই সময়টুকু না খেয়ে থাকলেও ক্ষতি নেই কারণ তখন শিরাপথে স্যালাইন দেওয়া হয়।
অ্যানেস্থেসিয়া বা অজ্ঞান করার বিষয় সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা
অপারেশনের আগেই অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট এর কাছ থেকে অ্যানেস্থেসিয়ার ধরন সম্পর্কে বিস্তারিত বুঝে নিন। রোগীর সম্পূর্ণ আরোগ্যলাভ নিশ্চিত করতে অপারেশনের পূর্ব সতর্কতার মতোই অপারেশনের পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে চিকিৎসকের সকল নির্দেশনা মেনে চলুন।
অ্যানেস্থেসিয়া বর্তমান চিকিৎসা ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যার সাহায্যে সার্জন জটিল জটিল অপারেশন নিরাপদে করতে সক্ষম হন। অমূলক ভয় না পেয়ে তাই অ্যানেস্থেসিয়া সম্বন্ধে জানুন এবং সচেতন হোন। যে কোনো অ্যানেস্থেসিয়া ব্যবহারে সুবিধা, অসুবিধা বা ঝুঁকি থাকতে পারে, তবে সব কিছুই নির্ভর করে রোগীর শারীরিক অবস্থা আর অপারেশনের ধরনের উপর। অপারেশনের আগেই অ্যানেস্থেসিয়া আর করণীয় সম্পর্কে বুঝে নিলে ভীতি অনেকটাই কেটে যায়।
ছবি- সাটারস্টক
The post অ্যানেস্থেসিয়া বা অজ্ঞান করার ব্যাপার নিয়ে কি ভয় কাজ করে? appeared first on Shajgoj.