সত্যি কথা বলি?
সিরিয়াসলি স্কিনকেয়ার করাটা শুধু কঠিনই নয় একই সাথে অনেক খরচের ব্যাপার। কারণ স্বাভাবিক, আপনার স্কিনের প্রবলেম সল্ভ করার জন্য যে শক্তির উপাদান দরকার হয় সেগুলো প্রোডাক্টে কনভার্ট করা, স্কিনে যেন কোন ধরনের সমস্যা দেখা না দেয় সেজন্য খুবই ভালো ফরমুলেশন এবং প্রিজারভেটিভ ইউজ করা , সাথে সাথে প্যাকেজিং আর মার্কেটিং এ অনেক খরচ হয় কসমেটিক ব্র্যান্ডগুলোর। তাই স্বাভাবিক ভাবেই, স্কিনে আসলেই রেজাল্ট দেখাতে পারে এবং স্কিন প্রবলেম কিছুটা হলেও সল্ভ করতে পারে এমন কসমেটিকগুলোর দাম থাকে আকাশচুম্বি… আর খুবই ভালো ব্র্যান্ডের প্রোডাক্ট হলে তো কথাই নেই!!
কিন্তু কয়জন আর স্কিনকেয়ারের পেছনে এত খরচ করতে চায় বলুন? অনেকে আবার এখনও আকাশ কুসুম স্বপ্ন দেখে, কেউ কেউ মনে করে ৫০০ টাকার ভেতরেই এমন একটা ক্রিম (!!) পাওয়া সম্ভব যেটা কিনা ব্রণ কমাবে, দাগ কমাবে, বলিরেখা কমাবে, স্কিন ব্রাইট করবে, গ্লো দেবে। এমন আবদার শুনলে একটু হাসি পায় বৈকি……!!! এমন ক্রিম (বার বার ক্রিম বলছি কারণ স্কিনকেয়ার বলতে বাঙালি এখনও ক্রিমই বোঝে!!) যা কোন সাইড ইফেক্ট ছাড়া এত কাজ করতে পারে তাও আবার ৫০০ টাকায়!!
পানি দিয়ে জেনারেটর চালানোর কিছু খবর মাঝে মাঝে শোনা গেলে যেমনটা লাগে আমার, এই আবদারগুলো শুনলে তেমনই লাগে… এমন জাদুর কুপি দুনিয়ায় চলে এল আর কেউ টেরই পেল না??
জাদুর কুপির দৈত্য ছাড়া এত আবদার কারও পক্ষে পুরন করা সম্ভব নয়… !
কিন্তু তারপরও, আমরা যারা বাজেট এ চলি, তাদের পক্ষে স্কিনকেয়ারের পেছনে একটা নির্দিষ্ট অংকের চেয়ে বেশি খরচ করাটা আসলে অসম্ভব! আর অনেক সময় এমন হয় আপনাদের সাথে? যে অনেক ভালো রিভিউ পড়ে একটা ক্রিম কিনলেন, হয়ত বা সেটার দামটাও অনেক বেশি ছিল। অনেক হোপফুল হয়ে ক্রিম রেগুলার ইউজ করা শুরু করলেন, তার পর মাসের পর মাস কেটে যায়, এত সাধের দামি ক্রিমটার কোন কার্যকারিতাই আপনার চখে পড়ে না!! না, স্কিনে কোন সমস্যা হয়ত তৈরি হচ্ছে না, কিন্তু সামান্য কোন উন্নতি দেখতে পাচ্ছেন না…
কি? ব্যাপারটা মন খারাপ করিয়ে দেয় না? মনে হয় না? এতগুলো টাকা পানিতে ফেললাম? ‘এটা’ না কিনে ‘ওটা’ কিনলে হয়ত ভালো হত……
কিন্তু, ব্যাপারটা তো অন্যরকমও হতে পারে… এমন হতে পারে যে আপনি যেভাবে , যে সময়ে অথবা যে কারণে প্রোডাক্টটা ইউজ করছেন,তা ভুল !! না জেনে না শুনে একটা ভালো মানের প্রোডাক্ট ভুলভাবে ইউজ করে নিজের কষ্টের টাকাগুলোনষ্ট করছেন?? আজকে এমন কিছু কারণ নিয়েই লিখব যেসব কারণে অনেক দামি, ব্র্যান্ডেড ভালো মানের প্রসাধনী ব্যবহার করেও আপনি বিন্দুমাত্র ফল পাচ্ছেন না। আশা করি এগুলোর দিকে খেয়াল রাখলে আপনার পকেটের অনেক টাকা বেঁচে যাবে…
১। আপনি ভুল প্রোডাক্ট ইউজ করছেন না তো?
আপনার বান্ধবীর মুখের স্কিনটোন আনইভেন। সে একটা প্রোডাক্ট কিনে ভালো ফল পেয়েছে। আর যায় কোথায়!!! সাথে সাথে দোকান থেকে সেটা নিয়ে এসে প্রবল উৎসাহে মাখা শুরু করলেন… কোন রেজাল্ট পেলেন না… তখন বান্ধবীকে প্রশ্ন করলেন, কই রে আমার ব্রণ তো ঠিক হল না??
কীভাবে হবে? আপনার প্রবলেম এক, আপনার বান্ধবীর প্রবলেম আরেক… যে ক্রিমটি স্কিনের নির্দিষ্ট সমস্যা দূর করার জন্য তৈরি হয়েছে সেটা আপনার সম্পূর্ণ আলাদা সমস্যা কীভাবে দূর করবে? এই ভুল থেকে বাঁচতে হলে, প্রথমে নিজের স্কিনে কী প্রবলেমের জন্য আপনি প্রোডাক্ট চাইছেন সেটা আগে নিশ্চিত হন। তারপর খোঁজ খবর নিন, কোন প্রোডাক্ট এই প্রবলেমের জন্য পারফেক্ট। এতে করে অনেক টাকা গচ্চা দেয়ার হাত থেকে বাচবেন।
২। আপনার স্কিন কি পরিস্কার এমন ডেড সেলস মুক্ত?
ক্রিম/ যেকোনো স্কিনকেয়ার প্রোডাক্ট দুইভাবে কাজ করে, হয়ত এটা আপনার স্কিনের উপরে একটা হালকা আস্তর তৈরি করে স্কিনের আদ্রতা ধরে রাখে, নয়ত বিশেষ কিছু উপাদান, যেগুলো কিনা আমাদের ত্বকের বাইরের লেয়ারের কিছুটা ভেতরে ঢুকে কাজ করতে সক্ষম এমন কিছু ব্যবহার করে।
আর এখানেই সমস্যা, স্কিনে ঢুকতে হবে তো রোমকূপ দিয়ে, কিন্তু আপনি কি জানেন, আপনার রোমকূপ পরিস্কার আছে কিনা? অনেকেই দেখি প্রশ্ন করছে-
‘শীতকালে স্কিন ড্রাই হয়ে গেছে, ক্রিম মাখি, কোন কাজ হয় না… এখন কি করব?’
একটু প্রশ্ন করলেই বোঝা যায় যে ইনি এই তীব্র শীতে মুখ ধোয়া বলতে গেলে বাদ দিয়ে দিয়েছেন। স্ক্রাব করে ত্বকের মরা চামড়ার লেয়ার দূর করা কি, তা হয়ত জানেনই না। ফলাফল, ত্বকের উপর পুরু মরা চামড়ার স্তর, যা ক্রমাগত সাদা সাদা হয়ে উঠছে, আর ইনি মুখে কয়েকটা পানির ঝাপটা দিয়ে সমানে দেশি বিদেশি দামি, কমদামি ক্রিম মেখেই চলেছেন… কিছুই নাকি তার উপরে কাজ করে না!!!
কোন প্রোডাক্ট স্কিনে মাখার আগে তাই একটু কষ্ট করে দেখে নিন আপনার স্কিন পরিস্কার আছে কিনা, আর রেগুলার স্ক্রাব করে স্কিনের ডেড সেলগুলো দূর করা হয় কিনা। নইলে এত শখের দামি ক্রিমের ভালো ভালো উপাদান ত্বকের উপরেই পড়ে থাকবে, পরের বার মুখ ধোয়ার সময় পানির সাথে ড্রেনে চলে যাবে। সাথে সাথে যাবে আপনার টাকা… আর স্কিন আজ যেমন আছে, ২০০০-৩০০০ টাকার ক্রিম মাখার পড়ও তেমনই থাকবে।
৩। আপনি কখন স্কিন কেয়ার প্রোডাক্ট ইউজ করছেন?
স্কিন কেয়ার প্রোডাক্ট ইউজ করার সবচেয়ে ভালো সময় হচ্ছে মুখ ধোয়ার ঠিক পড় পড়। তাই প্রতিবার ক্রিম দেয়ার আগে মুখ ভালোভাবে ধুয়ে নেবেন। কিন্তু তারপর পানি পুরোপুরি শুকিয়ে যেতে দেবেন না যেন! মুখ একটু ডাম্প/ ভেজা ভেজা থাকতে থাকতেই ক্রিম মাখুন। এতে করে মুখ থেকে পানি উড়ে যাওয়ার আগেই আপনার ময়েশ্চারাইজার স্কিনের উপর লেয়ার তৈরি করে পানিকে আটকাবে। আর আপনার স্কিন থাকবে সারাদিন সতেজ এবং আদ্র। মুখ ধোয়ার ২ ঘণ্টা পর ক্রিম মাখার কথা মনে পড়ল, আর ওমনি শুকনো খটখটে মুখে একগাদা ক্রিম স্কিনে মাখলেন, কোন লাভই হল না। কারণ যে পানিটুকুকে আটকানোর জন্য ক্রিম বানানো হয়েছে সে বাবাজি মুখ ধোয়ার ১০ মিনিটের মধ্যে ত্বক থেকে উবে গেছেন। একি কথা বডি লোশন/ অয়েল/ বাটারের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। স্কিন ভেজা থাকতে থাকতেই ময়েশ্চারাইজার লাগান।
৪। আপনার স্কিন টাই চেঞ্জ হয়ে যায়নি তো?
গত ১০ বছর ধরে একি ক্রিম মাখছেন? চিন্তা করছেন স্কিন কেন দিন দিন ডাল হচ্ছে? ১০ বছর আগে আপনার স্কিন হয়ত অয়েলি ছিল, ব্রণের সমস্যা ছিল। তখন একটা মনের মত প্রোডাক্ট পেয়ে গিয়েছিলেন তাই অনেক দিন ব্যবহার করেছেন। কিন্তু এখন হয়ত আপনার স্কিন অনেক ড্রাই, মুখে বলিরেখা হচ্ছে, তিল/ মেছতা হচ্ছে… আপনার প্রিয় ক্রিমের এখন আর আপনার স্কিনের প্রবলেম সল্ভ করার ক্ষমতা নেই। সুতরাং, আবার বলছি নিজের সমস্যা বুঝে প্রোডাক্ট ইউজ করুন।
এত গেল ১০ বছরের কথা, আমাদের স্কিন তো গরমে একরকম থাকে আবার বর্ষায় একরকম, আবার শীতে অন্য রকম। সুতরাং, সব সিজনে একি ক্রিম ইউজ করে কীভাবে আপনি আশা করেন যে আপনার স্কিন ভালো থাকবে? স্কিন কখন কী চায় তা বুঝুন। এটা আপনার ত্বক, আপনার চেয়ে ভালো তো আর অন্য লোক বুঝবে না।
৫। আপনি কি মানুষের মুখের কথা শুনে প্রোডাক্ট কেনেন? নাকি নিজে একটু খোঁজ খবর নেন?
লাস্ট কবে কসমেটিক কেনার সময় প্যাকেজিং এর গায়ের লেখা পড়েছিলেন, বলুন তো?? রোজ দেখি, অমুকের তমুকের কথা শুনে একটা ক্রিম কিনে একজন বসে আছে। তারপর সেটার ছবি তুলে জিজ্ঞেস করছে,
এটা কিনলাম, একটু বলবেন কীভাবে ইউজ করব?
হাসি চেপে রাখা দায় হয়ে যায়। আপনি ফেসবুক চালাচ্ছেন ইন্টারনেট দিয়ে, হয়ত খুবই আধুনিক স্মার্ট ফোনে, প্রোডাক্টের ছবি তুলে আমাদের পাঠাচ্ছেন!! আপনি কী, কীভাবে/কখন ইউজ করতে হবে এগুলো না দেখেই প্রোডাক্ট কিনে ফেলেছেন? নাকি প্রোডাক্ট নিজেই ভুতের আসরে আপনার কাছে চলে এসেছে? আপনি কি আপনার হাতে থাকা ক্রিমটার গায়ে থাকা লেখাগুলো পড়ে দেখার মত যথেষ্ট স্বাক্ষর নন? (যদি না হন, তবে আর কিছু বলার নেই, রূপচর্চা বাদ দিয়ে পড়ালেখায় মনযোগী হন…ভবিষ্যতে কাজে দেবে)
আবার একটা ছোট কৌটার ক্রিম যেটার সামনে পেছনে তার উৎপাদন তারিখ, সেটা আসলে সারটিফায়েড কিনা, উপাদান লিস্ট, কীভাবে কখন ব্যবহার করতে হবে কিছুই লেখা নেই… তারপরও শিক্ষিত প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ হয়ে সেটা কিনে বসে আছেন? এক্ষেত্রেও আমার কিছু বলার নেই। যার কাছ থেকে এসব revolutionary (!!) প্রোডাক্ট কেনার সুবুদ্ধি (!) পেয়েছেন তাকে জিজ্ঞাসা করুন, আমি বলব-
টাকার কথা, ফর্সা দুধে আলতা রঙের চিন্তা সব বাদ দিয়ে এটাকে আগে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে আসুন। মনে হয়ত দুঃখ থাকবে-
আহা, আমার আর ফর্সা হওয়া হল না!! কিন্তু যে সুস্থ নরমাল স্কিন আপনার এখন আছে সেটা অন্তত জলাঞ্জলি দিতে হবে না।
৬। সোজা কথা…
মুখের জন্য যে প্রোডাক্ট তৈরি হয়েছে, সেটা মুখে ইউজ করুন-
শীতকালে দেখি অনেকেই দিকবিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে মুখে বডি লোশন, বেবি লোশন, শরীরে মাখার ৫০% মিনারেল অয়েলযুক্ত অলিভ অয়েল, চুলে মাখার আমনড অয়েল এইসব কিছু মুখের স্কিনে ঘষা শুরু করে। এবং স্বাভাবিকভাবেই এরা জানেও না এবং জানতেও চায় না যে দেহের ত্বক মুখের ত্বকের চেয়ে ১০ গুন মোটা, যে জিনিস হাতে পায়ে মাখা যায় , তা মুখে মাখলে অনেক বড় অ্যাকসিডেন্ট হতে পারে!!
আর এই কারণেই শীতকালে অনেকের ব্রণ ওঠা শুরু হয়, মুখে গামলা গামলা অলিভ অয়েল লাগানর পরেও চামড়া ওঠা আর বন্ধ হয় না। অনেকের স্কিন তো এই সব উলটা পাল্টা প্রোডাক্ট ইউজ করার ফলে একদম সেনসিটিভ হয়ে নষ্ট হবার উপক্রম হয়। সুতরাং প্লিজ এগুলো করবেন না। বাজারে অনেক রিজনেবল দামে ফেস ক্রিম পাওয়া যায়, সেগুলো মাখুন। আপনি এমন কোন সাহারা মরুভুমি/ আমাজনের গহীন জঙ্গলে থাকেন না যে কোন উপায় না পেয়ে বডি অয়েল মুখে মাখতে হবে আপনার!!
আপনার যদি মনে হয় আপনার প্রসাধনীটি আপনি যেমনটা চাচ্ছেন তেমন ফল দিতে পারছে না। তবে উপরের পয়েন্টগুলো পড়ে চিন্তা করুন এর পেছনে কারণটা কি… বাজারে এত প্রোডাক্টের ভিড়ে কেউ প্রথমবারেই নিজের জন্য পারফেক্ট প্রোডাক্ট পেয়ে যায় না। কিন্তু একটু কেয়ারফুল হলে অনেক অজথা খরচ এবং ঝঞ্ঝাটের হাত থেকে অনায়াসেই বেঁচে যেতে পারবেন।
লিখেছেন – তাবাসসুম মুস্তারি মীম
ছবি – সোশ্যালগার্লওয়ার্ল্ড.কম