ইদানীং একটা জিনিস খুবই চোখে পরে, রেস্টুরেন্ট কিংবা পার্কে যেয়েও অনেক বাচ্চা মোবাইল নিয়েই বসে আছে! কোনো হুল্লোড় নেই, আশেপাশে কী হচ্ছে সেটা জানার আগ্রহ নেই, চোখদুটি তার ঐ ডিভাইসেই আবদ্ধ। মনে পরে যায় আমাদের শৈশবের কথা, কী প্রাণবন্ত ছিল সময়টা। প্রযুক্তির অপব্যবহারে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম কি তাদের দুরন্ত ছেলেবেলা হারিয়ে ফেলছে? বাচ্চাদের স্মার্টফোনে মাত্রাতিরিক্ত আসক্তি এখনকার দিনে বাবা মায়েদের দুশ্চিন্তার কারন। বায়না পূরণ করতে বা বাবা-মা কর্মব্যস্ততার জন্য বা বাচ্চাকে সাময়িকভাবে শান্ত রাখতে আমরা এর কুফল চিন্তা না করেই ডিভাইস তুলে দিচ্ছি তাদের হাতে। খেলনা, রঙ তুলির বদলে ছোট্ট শিশুর হাতে স্মার্টফোন দেখতেও তো বেমানান লাগে। এই আসক্তি দূর করতে বাবা মায়ের করণীয় কী? চলুন আজ আমরা এই ব্যাপারে একটু বিস্তারিত জানবো।
আগে একটি পরিসংখ্যান দেখে আসি
ইউনিসেফের তথ্য অনুসারে বিশ্বে প্রতি তিনজন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর একজন শিশু। আর প্রতিদিন এক লাখ ৭৫ হাজার অর্থাৎ প্রতি আধা সেকেন্ডে একজন শিশু নতুন করে ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে (সমকাল)। আর স্মার্টফোনের মাধ্যমেই ভার্চুয়াল জগতে খুব সহজেই প্রবেশ করে শিশুরা। ৩/৪ বছরের বাচ্চারাও এখন ইউটিউব চেনে, স্মার্টফোন দিয়ে আরামসে কার্টুন দেখা যায়! প্রযুক্তির আগ্রাসী আসক্তি থেকে নিরাপদ দূরত্বে নেই আমাদের দেশের শিশুরাও। বিটিআরসির তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে শিশুদের প্রায় ৩.৫ শতাংশ নিয়মিত ইন্টারনেট ব্যবহার করে থাকে!
বাচ্চার হাতে স্মার্টফোন কেন?
বর্তমান সময়ের কথা যদি চিন্তা করা হয়, তাহলে দেখবেন অনলাইনে ক্লাশ করার জন্য বাবা মায়েরা সন্তানের হাতে স্মার্টফোন তুলে দিচ্ছেন। এটা আসলে সিচুয়েশন ডিমান্ড, পড়াশুনা চালিয়ে যেতে করোনাকালীন সময়ে এই সাপোর্টের প্রয়োজন। কিন্তু একদম ছোট্ট শিশুকে কেন স্মার্টফোন দিয়ে ভুলিয়ে রাখতে হবে? খাওয়ানোর সময় মোবাইলে কার্টুন ছেড়ে দিলে বাচ্চা তাড়াতাড়ি খেয়ে ফেলে, কিছুটা সময় শান্ত হয়ে বসে থাকে- এই ধরনের কথা অনেক বাবা মায়ের কাছে শুনেছি। বাবা-মা কর্মব্যস্ততার, সন্তানকে ঠিকমতো সময় না দেয়া, পরিবারের সদস্যদের খামখেয়ালিপনা, একাকীত্ব, খেলাধুলার পরিবেশ না থাকা এসব কারনে বাচ্চাদের স্মার্টফোনে আসক্তি বেড়ে যাচ্ছে।
এতে আপনার সন্তানের কী ধরনের ক্ষতি হচ্ছে?
আমরা সবাই কিন্তু কমবেশি জানি যে মাত্রাতিরিক্ত মোবাইল ইউজ করা ছোট বাচ্চাদের জন্য কতটা ক্ষতিকর। তারপরও এখনো যারা এই বিষয়ে সচেতন না, তাদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি প্রযুক্তির অপব্যবহারে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম কতটা ঝুঁকির মুখে আছে।
- ইলেকট্রনিক গেজেটের অতিরিক্ত ব্যবহার শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়।
- শিশুর চিন্তাশক্তির বিকাশ বাঁধা পায় এবং সে ক্রিয়েটিভ কাজে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।
- মোবাইলে উচ্চগতিসম্পন্ন গেইমস বা মিডিয়া কনটেন্ট শিশুর স্বাভাবিক মনঃসংযোগে বিঘ্ন ঘটায়, বাচ্চাকে হাইপার অ্যাকটিভ করে তোলে।
- অনেক সময় শিশু তার প্রিয় কার্টুন চরিত্রের নেতিবাচক দিকগুলোই শেখে আর বাস্তবজীবনে সেটা প্রয়োগ করতে চায়।
- ঘণ্টার পর ঘণ্টা মোবাইলে গেইমস বাচ্চার চোখের ক্ষতি করে। মাথা ব্যথা, খাবারে অরুচি, কোমর ব্যথা, স্থুলতা বা মোটা হয়ে যাওয়া ইত্যাদি শারীরিক সমস্যাও দেখা দিতে পারে।
- আপত্তিকর কনটেন্ট শিশুকে সহিংসতা শেখায়। নৈতিক অবক্ষয় ঘটতেও সময় লাগবে না।
শিশুর মোবাইল আসক্তি কমাতে বাবা মায়ের ভূমিকা
বাচ্চার মোবাইল আসক্তি কমাতে বাবা মা ও পরিবারের অন্যান্যদের করণীয় কী হতে পারে সেটা জেনে নিন।
১) সময় বেঁধে দিন
প্রযুক্তির এই যুগে কার্টুন দেখা, মোবাইলে গেইমস এগুলো থেকে তো বাচ্চাকে দূরে রাখা সম্ভব না। সীমিত পরিসরে স্ক্রিন টাইম দিতে হবে। এই সময়ে শিক্ষামূলক বা সচেতনতামূলক কিছু দেখলে বাচ্চার জন্য সেটা ভালোই হবে, নতুন কিছু শিখতে পারবে। আর ব্রেইন ডেভেলপমেন্ট গেইমস, নামতা শেখা, ওয়ার্ড ম্যাচিং, রাইমস দেখা এগুলোর জন্য কিছুটা সময় দেয়া যেতে পারে, তবে আসক্তির পর্যায়ে যাতে না যায় সেটা খেয়াল রাখবেন। সময় বেঁধে দিন, যদি পারেন তো সেই সময়টুকু আপনি সাথে থাকুন ও শিশুবান্ধব ব্রাউজিংয়ের ফিচারগুলোও চালু রাখুন।
২) শিশুকে ব্যস্ত রাখুন
লেখালেখি, ক্রাফটিং বা কারুশিল্প, ইনডোর গেমস এসব দিয়ে শিশুকে ব্যস্ত রাখতে পারেন। নতুন নতুন খেলায় বাচ্চাদের আগ্রহ বাড়ে। বিভিন্ন অক্ষর দিয়ে শব্দ এবং শব্দ দিয়ে বাক্য বানাতে বলুন। রঙিন কাগজ দিয়ে নৌকা, প্লেন, ফুল বানিয়ে দেখান এবং তাকেও এভাবে বানাতে বলুন। কাগজ, রঙ পেন্সিল দিয়ে কার্ড বানাতে শেখান। খেলার ছলেই শেখা হয়ে যাবে। আর বাচ্চা লিখতে পারলে তাকে টপিক দিয়ে দিন, গল্প বা ছড়া লিখতে বলুন। এতে বাচ্চার মোবাইল গেইমসের নেশা অনেকটা কমে যাবে।
৩) বাগান করতে উৎসাহিত করুন
বেলকনিতে বা ছাদের এক কোনে টবে পছন্দের কিছু গাছ লাগাতে পারেন। বাচ্চাকেও এই কাজে উৎসাহিত করুন। আগাছা ক্লিন করবে, গাছে পানি দিবে, প্রকৃতির সাথে পরিচয় হবে। এতে বাচ্চারা আনন্দ পায়, নতুন নতুন ফুল ফল সবজি চিনতে শেখে। নিজের বাগানের যত্ন নিতে ব্যস্ত থাকবে, এতে সে ডিভাইস নিয়ে সারাদিন পরে থাকবে না, অর্থাৎ মোবাইল আসক্তি অনেকটাই কমে আসবে।
৪) নিজেরও ডিভাইস টাইম কমিয়ে দিন
বাচ্চা কিন্তু আপনাকে দেখেই শিখবে, তাই না? ওদের সামনে প্রয়োজন ছাড়া ডিভাইস ইউজ করবেন না। দরকারে করতে হলে সেটা বুঝিয়ে বলুন। আর কর্মজীবী বাবা মায়েরা ফ্রি টাইমটুকু সন্তানকে দিন, সারাদিন যে আপনার সন্তানকে দেখে রাখছে তাকেও কঠোরভাবে বলে দিন যাতে বাচ্চাকে সারাক্ষন ফোন হাতে না দেয়। অনেক অভিভাবককে দেখেছি বাচ্চাকে সময় দেয় না, বিরক্ত হয়ে হাতে ফোন ধরিয়ে দেয় যাতে সে চুপচাপ ওটা নিয়েই ব্যস্ত থাকে! এটা একদমই করবেন না। বাচ্চাকে সময় দিন, ওর শৈশবটাকে আরও আনন্দময় করে তুলুন।
এছাড়াও ছুটির দিনে মাঝে মধ্যে বাচ্চাকে নিয়ে ঘুরতে যাওয়া, তাকে ঘরের ছোটখাটো কাজে সাহায্য করতে বলা, গল্প শোনানো, গান শেখানো, ছাদে নিয়ে ঘুড়ি উড়ানো এগুলোও করতে পারেন। শিশুর হাতে স্মার্টফোন না দিয়ে কালারবুক, রঙ, খেলনা, ছড়ার বই দিন। আপনার সন্তানকে সুন্দর শৈশব উপহার দিতে পারেন একমাত্র আপনিই। তাহলে জেনে নিলেন তো কীভাবে বাচ্চাদের মোবাইলের প্রতি ঝোঁক দূর করা যায়। প্রযুক্তির অভিশাপ থেকে নিজে ও পরিবারকে সুরক্ষিত রাখতে পদক্ষেপ নিন আজ থেকেই।
ছবি- পান্ডাসিকিউরিটি, সাটারস্টক
The post শিশুর হাতে স্মার্টফোন | প্রযুক্তির আগ্রাসী আসক্তি থেকে বাচ্চাকে কীভাবে দূরে রাখবেন? appeared first on Shajgoj.