ঘুরাঘুরি মনকে প্রফুল্ল করে। অশান্ত মনকে শান্ত করার জন্য ঘুরাঘুরি করার কোন বিকল্প নেই। প্রকৃতির খুব কাছাকাছি চলে যেতে পারলে আপনার সকল ক্লান্তি দূর হতে বাধ্য। আর সেটা যদি সমুদ্র হয় তাহলে তো কথাই নেই। সমুদ্রের স্নিগ্ধ বাতাস গায়ে মাখলে আপনার সকল ক্লান্তি দূর হয়ে যাবে। কোলাহল মুক্ত পরিবেশ, সাগরপাড়ের হিমেল হাওয়া, চিকচিকে বালি এর সবই ভুলিয়ে দিবে আপনার মনকে এবং সমুদ্রের গাঙ্গচিলদের ডানায় ভর করে নিয়ে আসবে প্রশান্তি। সমুদ্রের জলে পা ভিজানোর জন্য যেকোন দ্বীপই হতে পারে আপনার গন্তব্য। আজকে কথা বলবো এমনি মনহরিণি একটি দ্বীপ সম্পর্কে। তাহলে চলুন দেড়ি না করে জেনে নেই কুতুবদিয়া দ্বীপ সম্পর্কে।
কুতুবদিয়া পরিচিতি
কক্সবাজার জেলার অন্তর্গত একটি উপজেলা হচ্ছে কুতুবদিয়া । এই উপজেলায় রয়েছে নানান বৈচিত্র্য। এই উপজেলার আয়তন প্রায় ২১৬ বর্গ কিলোমিটার। বৃহত্তর এই উপজেলায় রয়েছে দেশের সর্ববৃহৎ বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্র। এছাড়াও কুতুবদিয়া উপজেলায় রয়েছে লবণ চাষ, বাতিঘর, সমুদ্র সৈকত ও কুতুব আউলিয়ার মাজার।
ইতিহাস
কুতুবদিয়া মূলত একটি দ্বীপ উপজেলা। চতুর্দশ শতাব্দীর শেষের দিকে এই দ্বীপ সমুদ্রের বুকে জেগে উঠে বলে ধারণা করা হয়। পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষের দিকে এই দ্বীপে মানুষের আনাগোনা শুরু হয়। সর্বপ্রথম ‘কুতুবুদ্দীন’ নামক একজন সাধু ও পরহেজগার ব্যক্তি এই দ্বীপে বসবাস শুরু করেন। তিনি সকলের জন্যই এই দ্বীপটি উন্মুক্ত করে দেন। তখন আরাকান রাজ্য থেকে বিতাড়িত মুসলিমরা আশ্রয়ের জন্য এই দ্বীপে আসতে থাকে। কুতুবুদ্দীন এদেরও আশ্রয় দান করেন ফলে শ্রদ্ধা করে কুতুবুদ্দীনের নামানুসারে দ্বীপটির নাম রাখা হয় কুতুবদিয়া দ্বীপ। প্রথমে দ্বীপটির নাম ছিলো ‘কুতুবুদ্দীনের দিয়া’ যা পরবর্তীতে কালের বিবর্তনে লোকমুখে পরিবর্তন হয় এবং হয়ে যায় ‘কুতুবদিয়া দ্বীপ’।
কুতুবদিয়া দ্বীপের উল্ল্যেখযোগ্য স্থান সমূহ
এই দ্বীপে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি রয়েছে নানান দর্শনীয় স্থান। এ সমস্ত স্থান পর্যটকদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। প্রতিবছর হাজার হাজার দর্শনার্থী কুতুবদিয়া দ্বীপ আসে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে। তাহলে চলুন জেনে নেই কুতুবদিয়া দ্বীপের বিখ্যাত সেইসব দর্শনীয় স্থান সম্পর্কে।
১) কুতুব আউলিয়ার দরবার
কুতুব আউলিয়ার দরবার শরীফ কুতুবদিয়া দ্বীপের সবচেয়ে বিখ্যাত একটি স্থান। এটি এই দ্বীপ উপজেলার ধুরং নামক স্থানে অবস্থিত। শাহ আব্দুল মালেক আল কুতুবী এই দরবার শরীফের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ১৯১১ সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং মৃত্যুবরণ করেন ২০০০ সালে। শাহ আব্দুল মালেক আল কুতুবীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে সেই দরবার শরীফে দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়। তাই প্রতি বছর ৭ই ফাল্গুন হাজার হাজার ভক্তের সমাগম ঘটে কুতুব আউলিয়ার দরবার শরীফে।
২) কুতুবদিয়া চ্যানেল
কক্সবাজারের মাগনামা ঘাট থেকে এই দ্বীপ বা বন্দর এলাকায় যাওয়ার পথে কুতুবদিয়া চ্যানেল পাড়ি দিতে হয়। বছরের বেশীর ভাগ সময়ই এই চ্যানেল বেশ উত্তাল থাকে। শুধুমাত্র শীতকালেই এটি শিথিল থাকে। এই চ্যানেলের সৌন্দর্য একেক সময় একেক রকম। উত্তাল ঢেউয়ের সময় এর উপর দিয়ে তীব্র বাতাস অতিবাহিত হয়। আবার শীতের সময় হাড় কাঁপানো হিম শীতল হাওয়া বয়ে যায়।
৩) বাতিঘর
সমুদ্রে চলাচলকারী জাহাজ, ট্রলার ও ছোট নৌকাগুলোকে পথ দেখাতে বহুবছর আগে কুতুবদিয়া দ্বীপে একটি বাতিঘর নির্মাণ করা হয়। দূর থেকে আলোর ঝলকানির মাধ্যমে সে সমস্ত জলযান গুলোকে পথ দেখাতো এই বাতিঘর। কিন্তু বর্তমানে এটি বিলুপ্তপ্রায়। এখন শুধুমাত্র ভাটার সময় সেই বাতিঘরের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়। তবে সমুদ্র সৈকতের উত্তর-পূর্ব পাশে নতুন বাতিঘর নির্মাণ করা হয়েছে। যা দূর থেকে দেখতে খুবই আকর্ষনীয় লাগে।
৪) বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্র
কুতুবদিয়া দ্বীপ উপজেলায় বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্র অবস্থিত। এটি এই সমুদ্র সৈকতের দক্ষিণে অবস্থিত। দমকা বাতাসের জন্য প্রতিবছর এখানে প্রায় এক হাজার কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়।
৫) লবণ চাষ
শীতকালে এই দ্বীপটি একদম ঝিম মেরে যায়। তবে তখনও সেখানে পর্যটকদের পদচারণা সমানতালে চলে। কেননা শীতকালে এখানে প্রাকৃতিক উপায়ে লবণ চাষ করা হয়। দেশের বিখ্যাত লবণ চাষ কেন্দ্রগুলোর মধ্যে কুতুবদিয়া বেশ বিখ্যাত।
৬) কুতুবদিয়া সমুদ্র সৈকত
সূর্যাস্ত দেখার জন্য এই সমুদ্র সৈকতের তুলনা নেই। প্রায় ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত অবস্থিত এখানে। তবে এইদিকে অন্যান্য জায়গাগুলোর তুলনায় এই সমুদ্র সৈকতে মানুষের কোলাহল নেই বললেই চলে। এটি মূলত মাছ চাষের জন্য ব্যবহৃত হয় তাই এখানে জেলেদের কর্মব্যস্ততাই বেশী। সুর্যাস্তের পাশাপাশি এই সমুদ্র সৈকতের আরো একটি মনোরম দৃশ্য হচ্ছে গাঙ্গচিল। মাছ চাষের ফলে প্রচুর গাঙ্গচিল আসে এখানে। তখন এই নির্জন দ্বীপে এক মন্ত্রমুগ্ধকর পরিবেশের সৃষ্টি হয়।
যাওয়ার উপায়
ঢাকা থেকে কুতুবদিয়া যেতে হলে প্রথমে টি আর ট্রাভেলস, গ্রীন লাইন, সোহাগ পরিবহণ, হানিফ এন্টারপ্রাইজ, সৌদিয়া পরিবহণ, ইউনিক, শ্যামলী ও ঈগল এসি, নন এসি ইত্যাদি বাসে কক্সবাজার নামতে হবে। তারপর চকরিয়া উপজেলার বাসস্ট্যান্ড থেকে মগনামা ঘাট হয়ে কুতুবদিয়া পৌঁছাতে হবে। কক্সবাজার যেতে বাসভেদে ভাড়া লাগে ৬০০ থেকে ২৫০০ টাকা পর্যন্ত। চট্রগ্রাম থেকে যেতে চাইলে বদ্দারহাট কিংবা নতুন ব্রিজের বাসস্ট্যান্ড থেকে কক্সবাজার পৌঁছে সেখান থেকে কুতুবদিয়া যাওয়া যায়।
কোথায় থাকবেন
এটি বেশ ছোট একটি দ্বীপ ফলে এটি একদিনেই ঘুরে শেষ করা সম্ভব। তাই সকালে গিয়ে বিকালে কক্সবাজার ফিরে আসা যায়। তবে এখন কুতুবদিয়া বড়খোপ বাজারে পর্যটকদের জন্য বেশ উন্নতমানের কিছু হোটেলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেখানে থাকা যায়। সবচেয়ে ভালো হয় যদি ক্যাম্পিং করতে পারেন, কেননা এই দ্বীপটি ক্যাম্পিং এর জন্য আদর্শ।
কোথায় খাবেন
এখানে উন্নতমানের কোন খাবার হোটেল নেই। তবে বড়খোপ বাজারে কিছু ভালো ভালো হোটেল রয়েছে এবং সেখানে মোটামোটি ভালো স্থানীয় খাবার পাওয়া যায়।
সমুদ্রের খোলা মাতাল হাওয়ায় দুঃখ, যন্ত্রণা ভাসিয়ে দিয়ে নোনাজলে নিজেকে মুক্ত করে আনতে আজই ঘুরে আসুন কুতুবদিয়া দ্বীপ। কেননা আপনার জীবনে ভ্রমনই একমাত্র বন্ধু যা আপনাকে বিশ্ব সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ করতে সাহায্য করবে।
ছবি- সংগৃহীত: ঢাকাট্রিবুন.কম
The post কুতুবদিয়া | ঘুরে আসুন মনহরিণি একটি দ্বীপ থেকে! appeared first on Shajgoj.