ফর্সা হতে চান…? তবে আপনার জন্যই কিছু কথা।
বিখ্যাত সেই অ্যাড টা তো সবাই দেখেছেন…… ঐ যে, ‘ফ্রেশ মানেই সুন্দর…’ একবিংশ শতাব্দীতে আসার পরেও উপমহাদেশের racist ( আর কোন ভদ্র উপাখ্যান খুঁজে পেলাম না) মনোভাবের গালে কড়া চপেটাঘাত করেছিল এই বিজ্ঞাপনটি। আমরা আজও নিজের কালো মেয়ে অথবা ছেলেটার গায়ের রঙ নিয়ে কপাল চাপড়াই। রাস্তায় কালো মানুষটাকে নিয়ে হাসা হাসি করি আর দেয়ালের আয়নায় তাকিয়ে রাজ্যের ক্রিম মুখে ঘষি, মনে গোপন আশা – ‘ইশ… আর একটু ফর্সা যদি হতাম!’
দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, আজকাল আধুনিক যুগে যখন আমরা মনে করেছিলাম কালো মেয়েটার রঙ ফর্সা করার ক্রিমটা বোধহয় এবার বাজার থেকে উঠে যাবে, আমরা আধুনিক না ?? কিন্তু কই? তারা বরং কালো ছেলেটার জন্যও আরেকটা ক্রিম বের করে আরও জাঁকিয়ে ব্যাবসা শুরু করল! না পাঠক, আমি বলছিনা সুন্দর হতে চাওয়াটা দোষ। বরং নিজেকে সুস্থ সুন্দর রাখাটা একজন মানুষের অধিকার। আর আমরা সাজগোজে বাংলাদেশের মানুষের লাইফস্টাইল নিয়েই তো কথা বলি। কিন্তু মাঝে মাঝে খারাপ লাগে, যখন দেখি কোন আধুনিক, বুদ্ধিমান এবং উচ্চশিক্ষিত পাঠকের মুখেও সেই আদি যুগের প্রশ্ন আবার শুনি-
আচ্ছা, গায়ের রঙটা কালো হয়ে যাচ্ছে, ‘অমুক’ ক্রিমটা কি ভালো ?? আমার এক আত্মীয় এটা ব্যবহার করে একমাসে একদম ধবধবে ফর্সা হয়ে গেছে। আমিও কিনেছি। প্লিজ, জানাবেন………
কীভাবে এখন এই প্রশ্নের জবাব দেই? পাঠক যেখানে নিজের চোখে কাউকে ‘ধবধবে ফর্সা’ হয়ে যেতে দেখেছেন! হোক সেই ক্রিমের গায়ে কোন উপাদান লেখা নেই, আবার কোন কোনটায় নামও লেখা থাকে না। (জিঞ্জিরা প্রডাকশন) আবার ছোটবেলা থেকে বারবার শুনেছেন যে এই সব প্রোডাক্টে যে সব উপাদান থাকে তাতে স্কিন ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে। তারপরও ‘ধবধবে ফর্সা’ রঙের মোহে ঠিকই কিনে বসে আছেন। এখন প্রশ্ন করে লাভ কী? আমি জানি ঐ প্রোডাক্ট আপনি ব্যবহার করবেনই।
আসলে বেশ বিরক্ত হয়ে লিখতে বসেছিতো… ভূমিকাই অনেক লম্বা হয়ে গেল। আজকের লেখার উদ্দেশ্য আপনাদের রঙ ফর্সাকারী ক্রিমের আসল উপাদান গুলোর সাথে কম কথায় পরিচয় করিয়ে দেয়া। আপনাদের বলতে পারতাম কোন ক্রিম কেনার সময় উপাদান দেখে কিনবেন, কিন্তু জানি বেশিরভাগ মানুষেরই কষ্ট করে উপাদান পড়ার ধৈর্য থাকে না। আর আমাদের দেশের কোন রঙ ফর্সাকারী ক্রিমগুলোর গায়ে উপাদান লেখার বালাই থাকে না। তারপরও আপনার মনে যদি কোন ছোট কৌটায় ভর্তি ক্রিম যেটা ব্যবহার করে আপনার পাশের বাসার একজন এক সপ্তাহে দুধে আলতা হয়ে গেছেন সেটা কেনার সুপ্ত বাসনা থাকে তবে একটু কষ্ট করে নিচের পয়েন্ট গুলো পড়ে নিন-
নিচের উপাদানগুলো আমাদের উপমহাদেশের রঙ ফর্সাকারী ক্রিম গুলোর প্রধান উপাদান-
১। পারদ (Mercury)
গায়ের রঙ ফর্সা করার হিরো! পারদের বিষে আক্রান্ত হয়ে যারা মারা যায় মৃত্যুর সময় তাদের গায়ের রঙ থাকে একদম সাদা! ঠিক যেমনটা বাংলার মানুষ ভালোবাসে! আর তাই ফেয়ারনেস ক্রিমেও এতো কার্যকরী আর সহজলভ্য উপাদানের উদার ব্যবহার লক্ষণীয়! আসুন দেখি পারদের গুণাবলি-
- গায়ের রঙ ফর্সা করার জন্য ইংল্যান্ডে মধ্যযুগ থেকে জনপ্রিয়। অনেক মহিলারা সারাজীবন দেহে পারদ মেখে ৩০-৪০ বছর বয়সে শ্বেত সুন্দর দেহ নিয়ে মৃত্যুবরণ করতেন।
- নিয়মিত ব্যবহারে গায়ের রঙ একদম ফ্যাকাসে সাদা হয়ে যাবে, তা আপনি যত কালোই হন না কেন!
- অনায়াসে আপনার লিভার আর কিডনি নষ্ট করে দিতে পারবে।
২। হাইড্রোকুইনন (Hydroquinone )
- খুবই কার্যকরী ব্লিচিং এজেন্ট। সাধারণত ব্লিচিং ক্রিম গুলোয় ব্যবহার করা হয়। অত্যন্ত বিখ্যাত ( নাম না নেয়াই ভালো) কিছু ফেয়ারনেস ক্রিমের প্রধান উপাদান।
- রেগুলার ব্যবহারে ত্বক আস্তে আস্তে পাতলা করে দেয় আর সেন্সিটিভিটি বাড়ায়।
- অপরিমিত ব্যবহারে দেহের লিগামেন্ট, টেনডন আর ত্বকের স্থায়ী ক্ষতি করে।
৩। STEROIDS
- ম্যাক্সিমাম ফেয়ারনেস ক্রিমের staple উপাদান। খুবই দ্রুত গায়ের রঙ ফর্সা করার জন্য বিখ্যাত। সুতরাং, বুঝতে পারছেন তো? এক সপ্তাহে কালো মানুষ কীভাবে দুধে আলতা হয়??
- দেহের ন্যাচারাল STEROID প্রডাকশন হতে দেয় না।
- হরমোন নিঃসরণে বিভিন্ন সমস্যা তৈরি করে cystic ব্রণ, অ্যালার্জি, তিল আর শ্বেতি রোগের মত সমস্যা তৈরি করে।
- অনেক সময় দেখা যায় steroid ব্যবহার করে ফর্সা হবার পর ক্রিম ব্যবহার ছেড়ে দিলে গায়ের রঙ আগের থেকেও কালো হয়ে যায়।
রোদে পোড়া দাগ দূর করার জন্য কিছু সেইফ উপাদান-
রোদে পোড়া ভাব বা ট্যান দূর করা গায়ের রঙ ফর্সা করা থেকে খুবই আলাদা। এক্ষেত্রে আপনি কখনই আপনার জন্মগত রঙ থেকে ফর্সা হতে পারবেন না। নিচে জানাচ্ছি কিছু নিরাপদ উপাদানের নাম যা বিভিন্ন ন্যাচারাল সোর্স থেকেও পাওয়া যায়। এগুলো ট্যান কাটাতে সাহায্য করে –
১। ভিটামিন সি
- আসকরবিক অ্যাসিড রুপে কস্মেটিকসে ব্যবহার করা হয়। কত তাড়াতাড়ি আপনি ত্বকে লক্ষণীয় পরিবর্তন দেখবেন তা ভিটামিন সির শতকরা হারের উপর নির্ভর করে
- যদি কস্মেটিকে ১০% এর বেশি ভিটামিন সি ব্যবহার করা হয় শুধু তাহলেই এই ভিটামিন ত্বকের সেল টার্নওভার দ্রুত ঘটিয়ে ট্যান আর দাগ দূর করতে পারে।
- ত্বকে কোলাজেন তৈরির হার বাড়িয়ে ত্বক ঝুলে পড়া আর বলিরেখা কমাতে সাহায্য করে।
২। ভিটামিন এ
- সৌন্দর্য জগতে রেটিনল নামে ব্যবহার করা হয়। ব্রণের সমস্যা আর বলিরেখায় প্রায় সব ডাক্তাররাই রেটিনল সাজেসট করেন।
- ত্বকের হাইপার পিগমেনটেশন দূর করতে সাহায্য করে।
৩। আরবুটিন (ARBUTIN)
- হাইড্রোকুইননের সেফ alternative! কিন্তু প্রডাকশন কস্ট বেশি চলে আসে বলে সস্তা ফেয়ারনেস ক্রিমে বিক্রেতারা ব্যবহার করেন না।
- পরিমিত মাত্রায় ব্যবহার করলে নিরাপদে জেদি রোদে পড়া দেহের ট্যান দূর করতে পারে।
- বিভিন্ন নামি দামি স্কিনকেয়ার ব্র্যান্ডে আরবুটিনের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য।
৪। আলফা হাইড্রক্সিল অ্যাসিড (ALPHA HYDROXYL ACID)
- আমাদের আশেপাশের সব টক ফল থেকেই আমরা এটা পেতে পারি। সবাই নিশ্চয়ই দেখেন কস্মেটিকে কীভাবে লেবু, কমলা, আপেল, আনারস ব্যবহার করার কথা বলা হয়। আসলে তারা শুধু এই অ্যাসিড ব্যবহার করে যা প্রাকৃতিক সোর্স থেকে পাওয়া যায়।
- সাইট্রিক এসিড (লেবু, কমলা), গ্লাইকলিক এসিড (আখ থেকে), ল্যাকটিক এসিড (দুধ আর দুগ্ধজাত পণ্য), ম্যালিক আর টারটারিক এসিড(আপেল আর আঙ্গুর) এই সবগুলোই হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের আলফা হাইড্রক্সিল অ্যাসিড বা AHA
- নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন ট্যান দূর করতে লেবুর এতো কদর কেন?
তো আমি যতদূর সম্ভব সংক্ষেপে আর সহজে আপনাদের পাশের বাড়ির ‘অমুকের’ প্রিয় ফেয়ারনেস ক্রিমের উপাদান সম্পর্কে একটু জ্ঞান দেবার চেষ্টা করলাম। হ্যাঁ, আমি অবশ্যই বলব যে বাহ্যিক সৌন্দর্যই সব কিছু নয়। কিন্তু আমি শেষ করতে চাই এটুকু বলে-
কেন আপনি সুন্দর হবেন না? অবশ্যই হবেন। কিন্তু অন্তত নিজের চোখ কান খোলা রাখুন। আপনি আমার এই লেখা যখন পড়তে পাড়ছেন তার মানে আপনার হাতে আছে ইন্টারনেট! একবিংশ শতাব্দীর সুপার পাওয়ার। এখনও যদি আপনি অন্য মানুষের শোনা কথা বিশ্বাস করেন তবে ফেয়ারনেস ক্রিমের যুগ শেষ হতে আরও শত বছর লেগে যাবে। আর যুগ যুগ ধরে বাদামি বাঙ্গালির সাহেব মেমদের মত ফর্সা হবার সাধ কোনদিন মিটবে না।
লিখেছেনঃ মীম তাবাসসুম
ছবিঃ ওনলিস্কিনহোয়াইটেনিং.কম