বিংশ শতাব্দীতে বাংলাদেশে লেখালেখি ভুবনের প্রবাদ পুরুষ, জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিক, বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তী- শ্রদ্ধেয় হুমায়ূন আহমেদ! বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী শ্রেষ্ঠ লেখক হিসেবে তাঁকে বিবেচনা করা হয়। সত্তর দশকের শেষ ভাগ থেকে শুরু করে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনিই ছিলেন একমাত্র বাংলা গল্প উপন্যাসের অপ্রতিদ্বন্দ্বী কারিগর। আজও তার জনপ্রিয়তা আকাশ স্পর্শী। তিনি একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোট গল্পকার, নাট্যকার, চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং গীতিকার। তিনি বেশ কিছু সায়েন্স ফিকশন লিখেও কৃতিত্ব অর্জন করেছেন। তিনি তার প্রতিটা গল্প উপন্যাসে মধ্যবিত্ত জীবনের চলমান কথকতা এমন সহজ সরলভাবে উপস্থাপন করেছেন, যার জন্য পাঠকরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো আচ্ছাদিত হয়ে থাকে। মনে হয় তিনি যেন আমাদের প্রত্যেকের গল্পই বলছেন। তার বেশ কিছু গ্রন্থ পৃথিবীর নানা ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে এবং বেশ কিছু স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যসূচীর অন্তুর্ভুক্ত করা হয়েছে। তার রচিত গল্পগ্রন্থ ও উপন্যাসের সংখ্যা প্রায় ২০০ এর উপরে।
প্রথম উপন্যাস নন্দিত নরকে’র মাধ্যমেই সাহিত্য অঙ্গনে তার আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। যদিও তার প্রথম লিখিত উপন্যাস ছিল “শঙ্খনীল কারাগার” কিন্তু নন্দিত নরকে তার প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস। ১৯৭০ সালে লিখিত এই উপন্যাস ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রকাশ করা সম্ভব হয় নি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে ঢাকা থেকে প্রকাশিত মাসিক “মুখপাত্র” নামের একটি সংকলনে নন্দিত নরকে উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়। তার লেখনিতে আকৃষ্ট হয়ে বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবি ও সাহিত্যিক আহমদ সফা উপন্যাসটি পুস্তকাকারে প্রকাশের উদ্যোগ নেন। উপন্যাসটি তখন খান ব্রাদার্স এন্ড কোং কর্তৃক গ্রন্থাগারে প্রথম প্রকাশিত হয়। প্রখ্যাত বাংলা ভাষা শাস্ত্র পন্ডিত আহমদ শরীফ স্ব-প্রণোদিত হয়ে এ উপন্যাসটির ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন। প্রথম প্রকাশিত উপন্যাসেই সফলতার মুখ দেখেছিলেন তিনি। পরবর্তীতে ২০০৬ সালে এই উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্রও নির্মাণ করা হয়। অসংখ্য গল্প উপন্যাস সৃষ্টির জনক হুমায়ূন আহমেদের অন্যতম জনপ্রিয় উপন্যাস “নন্দিত নরকে” নিয়ে আমি আজ ছোট্ট একটি রিভিউ দিচ্ছি।
নন্দিত নরকে বইয়ের বিবরণ
১. বইয়ের নাম- নন্দিত নরকে
২. ধরন- সামাজিক
৩. লেখক- হুমায়ূন আহমেদ (১৯৪৮-২০১২)
৪. প্রকাশনাকাল- ১৯৭২
৫. প্রকাশক- খান ব্রাদার্স এন্ড কোং (প্রথম প্রকাশ), দিব্য প্রকাশ (দ্বিতীয় প্রকাশ)
৬. প্রচ্ছদ- প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ও সাহিত্যিক মুহম্মদ জাফর ইকবাল (প্রথম সংস্করণ), বিখ্যাত চিত্র শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী (দ্বিতীয় সংস্করণ), ধ্রুব-এষ (তৃতীয় সংস্করণ)
কাহিনী সংক্ষেপ
উপন্যাসটি খুব সাধারণ একটা নিম্নবিত্ত পরিবারের জীবন সংগ্রাম নিয়ে লেখা, যে পরিবারেরই মানসিক বিকারগ্রস্ত মেয়ে রাবেয়া। রাবেয়াকে ঘিরেই পুরো গল্পের পটভূমি। এছাড়া এ গল্পে আছে মা, বাবা, ভাই, বোন, শফিক সহ অনেকেই। চার ভাই-বোনের মধ্যে বড় মেয়ে রাবেয়া বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। তার এক বছরের ছোট খোকা যে কিনা মাস্টার্স পরীক্ষার্থী, এর পর বেখেয়ালী স্বভাবের মন্টু, যে রাবেয়ার বাবার প্রথম বউ এর ছেলে আর সবচেয়ে ছোট মেয়ে রুনু। ছয় সদস্যের এ পরিবারটির সাথে থাকে তাদের বাবার ভার্সিটি জীবনের বন্ধু শফিক। শফিক সাহেবকে তাদের বাবা তাদের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলেন। শফিক একটি স্কুলে শিক্ষকতা করেন সেই সাথে রাবেয়াদের ভাই-বোনদের পড়ান।
উপন্যাসটিতে লেখক পাশের বাড়ির ধনী পরিবারের মেয়ে শিলু ও তার ভাই হারুনকেও তুলে এনেছেন। বুদ্ধি প্রতিবন্ধী রাবেয়ার প্রতি হারুনের রয়েছে দূর্বলতা আর শিলুকে নিয়ে আছে খোকার মনে চাপাপড়া আবেগের ঘটা, যা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের কাছে স্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই নয়। পুরো গল্পটি জুড়েই আছে একটি পরিবারের দুঃখ ও কষ্টের এক বিষাদ বর্ণনা।
চৈত্রের এক দুপুরে হঠাৎ একদিন রাবেয়া হারিয়ে যায়! অনেক খুঁজাখুঁজি করেও তাকে যখন পাওয়া যাচ্ছিলো না। তখন স্কুল থেকে ফেরার সময় মাস্টার কাকা তাকে পেয়ে বাড়িতে নিয়ে আসে। কিছুদিন যাওয়ার পর হঠাৎ রাবেয়ার শারীরিক পরিবর্তন ধরা পরতে থাকে! তখন তার মা শাহানার বুঝতে অসুবিধা হয় না যে রাবেয়া সন্তান সম্ভবা। কিন্তু মানসিকভাবে অসুস্থ রাবেয়া মা, ভাই এর শত জিজ্ঞাসার পরও কিছুই বলতে পারে না! বাবা তখন রাবেয়াকে বিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। সামাজিক লোক লজ্জার ভয়ে একদিন ভোর বেলায় নিজ ঘরেই রাবেয়াকে গোপনে গর্ভপাত করানো হয়। কিন্তু অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে রাবেয়া মারা যায়!এই ঘটনায় মন্টু মাস্টার কাকাকে দায়ী করে বাড়ি ভর্তি লোকজনের সামনেই তাকে ধারালো বটি দিয়ে কুপিয়ে খুন করে। পুলিশ মন্টুকে ধরে নিয়ে যায় আর ঠান্ডা মাথায় মাস্টারকে খুন করার অপরাধে তার ফাঁসির রায় হয়ে যায়। গল্পে লেখক রাবেয়া কার লালসার স্বীকার হয়েছিল তা সরাসরি না বললেও পাঠকরা গল্প পড়ে বা মাস্টার কাকার উপর মন্টুর এরূপ আক্রমণে বুঝতে পারবে যে মাষ্টারই তার সর্বনাশ করেছিল। উপন্যাসের শেষ অংশটি লেখক খুবই করুণভাবে উপস্থাপন করেছেন। জেল গেটে একজন দুঃখ-শোকে কাতর বাবা আর অসহায় এক ভাই ভোর রাতে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে তাদের প্রিয় মন্টুর মৃতদেহের অপেক্ষায়!
শেষ কথা
উপন্যাসটিতে বাইরের দুনিয়ায় মেয়েরা যে কতটা অনিরাপদ সেটাই রাবেয়ার জীবনের করুণ পরিণতির মাধ্যমে লেখক বুঝিয়ে দিয়েছেন। সবদিক দিয়ে বিবেচনা করলে বলা যায় “নন্দিত নরকে” হুমায়ূন আহমেদের এক অনবদ্য সৃষ্টি। এক কথায় শ্রেষ্ঠ একটি উপন্যাস!
ছবি- সংগৃহীত: সাজগোজ; বাংলা আওয়ার.কম; বই পড়ি.কম
The post নন্দিত নরকে | হুমায়ুন আহমেদের প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস appeared first on Shajgoj.