আজকাল বাংলাদেশের প্রচুর টিন-এজারদের ফেসবুক একাউণ্ট আছে। যে কারণে আমাদের ‘সাজগোজ’ ওয়েবসাইটের পাঠকদের একটি বড় অংশই টিন -এজাররা (১৩-১৯ বছর)। কিন্তু সমস্যাটা হয়ে গেছে এখানেই। সাজগোজে প্রচুর স্কিনকেয়ার, মেকাপ, কস্মেটিক রিলেটেড আর্টিকেল শেয়ার করা হয়। যেগুলো আমাদের টিন-এজার পাঠক খুব মন দিয়ে পড়ে (মনোযোগ দিয়ে যে পড়ে সেটা বোঝা যায় আমাদের ইনবক্সের প্রশ্নগুলো দেখলে) কিন্তু তারা এটা দেখে না যে এসব আর্টিকেল কাদের উদ্দেশ্যে লেখা!
সাজগোজের বেশিরভাগ রূপচর্চার আর্টিকেল ২২ থেকে বেশি বয়সের পাঠকদের জন্য লেখা হয়। যার ভেতরে স্পেশালই আমাদের ফেসিয়াল সংক্রান্ত আর্টিকেল এবং বিভিন্ন কেমিক্যাল প্রসিডিওর এবং এর পরবর্তী যত্ন সংক্রান্ত লেখাগুলো পড়ে। আমরা যারা এই আর্টিকেলগুলো লিখি তারাও এসব সার্ভিস ২২-২৩ বছর বয়সেই নেয়া শুরু করেছি। কিন্তু আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি ১৪ বছর বয়সের কোন পাঠক ফেসিয়ালের আর্টিকেলগুলো দেখে বাসায় নিজে নিজে অথবা পার্লারে গিয়ে গোল্ড ফেসিয়াল করার চেষ্টা করবে অথবা কোন রিবনডিং কিট কিনে সে নিজে নিজে বাসায় রিবনডিং করতে পারে আর সেটা কোথায় পাওয়া যায় সেটা জানতে চাইবে!!! একদিন তো এক ষোড়শী কে ব্লিচ করার কুফল বলার পড়ে সে বলেই ফেলল-
আমার সব ফ্রেন্ডরা অনেক ফর্সা। ওদের সাথে বাইরে গেলে লজ্জা লাগে। ছবি তুললে আমাকে ওদের পাশে অনেক কালো দেখায়। আপনি আমার বোনের মত আপু, আমাকে বলুন না, ব্লিচ করলে কি একটু ফেয়ার হতে পারব???
আমার আর কিছুই বলার ছিল না। GOOD BYE, CHILDHOOD!!!
দুঃখজনক হলেও সত্যি আজকাল টিন-এজার রা এতটা এক্সপোসড হচ্ছে সোশাল মিডিয়া দিয়ে যে তারা তাদের শৈশব হারাতে বসেছে। কিন্তু এটা কোন অজুহাত নয় নিজের ব্যক্তিত্ব জলাঞ্জলি দিয়ে অন্যের সাথে অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়ার। ফেসবুকে সুন্দর ছবি দিয়ে লাইক কামানোর(!) জন্য এত অল্প বয়সে ফুল মেকাপ নিয়ে শপিং কমপ্লেক্সে/সিনেমায় গিয়ে শো অফ করাটা স্মার্ট নেসের ভেতরে পড়ে না।
তার চেয়েও বড় কথা, সবকিছুর একটা নির্দিষ্ট সময় আছে। জানি মেকাপের প্রতি এই অসুস্থ অবসেশন টিন-এজদের ভেতরে এসেছে যুবক-যুবতিদের দেখে। কারণ টিন-এজাররা অবচেতন মনেই নিজেদের অনেক বড় ভাবে। তারা মনে করে,
‘অমুক তো আমার চেয়ে কয়েক বছরের বড় মাত্র!! সে এটা করতে পারলে আমি কেন পারব না??”
এছাড়া দোষ আছে আমাদেরও। আমরা কখনই টিন -এজারদের জন্য কিছু বলি না। সুতরাং তারা মনে করে এখানকার সবকিছুই হয়ত তারা ফলো করতে পারবে। আর এজন্যই আজকের এই লেখায়। আমার ইচ্ছা এই লেখাটা কয়েকটি পর্বে লেখার ( কারণ অনেক কিছু বলার আছে, অল্প পরিসরে হবে না!)
সুতরাং, টিন- এজারদের স্কিন কেয়ার নিয়ে প্রথম পর্বের এই লেখায় আজকে আমি খুব স্বাভাবিক কিছু টিপস দিব।
নিজের সম্পর্কে জানা-
নিজের যত্ন নেয়ার শুরুতেই জানতে হবে নিজের ত্বক, চুল সম্পর্কে কিছু তথ্য-
- নিজের ত্বকের ধরন কি?
সকালে ঘুম থাকে উঠে সরাসরি মুখ ধুতে চলে যাবেন না। আয়নায় দাড়িয়ে একটা টিস্যু পেপার মুখে চেপে ধরুন প্রায় ১০ সেকেন্ড। এরপর টিস্যুটা ভালো করে দেখুন। যদি টিস্যুর কোথাও তেলের ছাপ না থাকে তবে আপনার স্কিন ড্রাই, যদি শুধু নাকে এবং কপালের অংশ টুকুতে তেলের ছোপ থাকে, বাকিটা ড্রাই তবে আপনার স্কিন কম্বিনেশন, আর যদি কপাল, থুতনি আর নাকসহ নাকের আশে পাশে বড় সড় একটা অংশে তেলের ছোপ থাকে তবে আপনার স্কিন তৈলাক্ত/ অয়েলি।
- নিজের চুলের ধরণ কি?
ত্বকের ধরনের উপরে চুলের ধরণ অনেকটা নির্ভর করে। তবুও যদি দেখেন আপনার চুল একদিন শ্যাম্পু না করলেই তেল চিট চিটে হয়ে যায় তবে আপনার চুল এবং স্কাল্প অয়েলি। আর যদি চুলের রঙ লালচে হয়ে থাকে এবং প্রচুর চুলের আগা ফাটা থাকে তবে চুল ড্রাই। অনেকের এমন ও হতে পারে যে চুলের আগাও অনেক ফাটে এবং স্কাল্প অনেক বেশি অয়েলি। এধরনের চুলের জন্য নিতে হবে বিশেষ যত্ন।
- স্বাস্থ্য সম্পর্কে ধারনা-
কোন এক অজানা কারণে আমাদের দেশের অনেক বাবা মা নিজের টিন -এজার সন্তানকে নিজের যত্ন নিজে নিতে শেখায় না এবং স্বাস্থ্য সংক্রান্ত জ্ঞান একেবারেই দেয় না। হয়ত তারা মনে করে সন্তান নিজেই শিখে নেবে। আর সন্তান নিজে বেশি “পণ্ডিতি” করে জ্ঞানের অভাবে একেকটা দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেললে মা বাবা সেটাকে সন্তানের ভুল বলে চালিয়ে দেয় অথবা কপালের দোষ টাইপের কোন একটা অজুহাতে নিজের গাফেলতি ঢাকার চেষ্টা করে।কিন্তু নিজের স্বাস্থ্যের যত্ন এখনি নেয়া না শিখলে একটু বয়স বাড়লে যে রোগ ব্যাধিগুলো হবে সেগুলর মুখোমুখি হওয়ার ক্ষমতা আছে তো?? নিজের বাবা মা অথবা আত্মীয়কে জিজ্ঞাসা করে দেখবেন তো- রক্তচাপ জনিত রোগ, হার্টের রোগ, হাড়ের ক্ষয়, রক্ত শূন্যতা এসব হলে কেমন লাগে?? রোগের জ্বালায় সোশাল মিডিয়ার ঠুনকো লোকদেখানো স্মার্টনেস দেখানোর সময় তাদের হয়ে ওঠে কিনা???
এখন সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত নীরোগ শরীর অযত্নে অবহেলায় অনেকেই নষ্ট করবে। তারপর দুনিয়ার সব ধন রত্ন দিয়েও একটা সুস্থ দেহ পাবেন না। আর এই জন্য কিছু ভালো অভ্যাসের কথা বলব। যেটা একটু মন দিয়ে পড়ে ফলো করলে হয়ত অনেক বাজে রোগ থেকে মুক্তি পাবেন-
১। সময় মত খাওয়া-
আজকাল অমুকের সাথে রাগ করে, তমুকের ওপরে অভিমান করে না খেয়ে থাকাটা অনেক টিন -এজারের মধ্যে ফ্যাশন হয়ে গেছে। কিন্তু সত্যি কথা এটাই এই বাজে হ্যাবিটের কারণে অমুক তমুকের পেটের কিচ্ছু আসবে যাবে না। গ্যাস্ট্রিক, অ্যাসিডিটি যা হওয়ার সব আপনাদেরই হবে। দুনিয়া উল্টে গেলেও তাই নিজে সময় মত খাবেন। ক্লাস, পরিক্ষা, কোচিং এসবের অজুহাত দিয়ে খাওয়া বন্ধ রাখলে কিন্তু ঠিকমত বাড়বেনও না। কিছু বছর পর হঠাৎ যখন মনে হবে,
আরে!! আমি এত খাটো কেন??
তখন বোকার মত ১ মাসে ৬ ইঞ্চি লম্বা হউন অ্যাডের দিকে এই আপনারাই হাত বাড়াবেন!!!
২। জাঙ্কফুড কম খান-
টিন- এজে এমনিতেও বিভিন্ন হরমনাল কারণে অনেক ব্রণ, র্যাস ইত্যাদি হয়। আর এই প্রব্লেমগুলো মাথায় চড়ে বসে অতিরিক্ত জাঙ্ক ফুডের বদৌলতে। অনেক টিন- এজার ছেলে মেয়েরাই কিছু না চিন্তা করে, ব্রণ হয়েছে কী করব?? একটা ক্রিমের নাম বলুন!! এধরনের প্রশ্ন করে। তাদের জন্য একটিই কথা, খাটি বাংলায়, জাঙ্ক ফুড ইচ্ছা মত খেয়ে স্কিনের যে অবস্থা আপনারা করেছেন, এর উপরে আবার না বুঝে ক্রিম ঘষলে একমাত্র ক্রিম কোম্পানির মালিকের লাভ হবে!! আপনার ব্রণের কিচ্ছু আসবে যাবে না। আর টিন- এজের ব্রণ মুখে যে যা বলবে সেই ডিম, ডাল হ্যান ত্যান মাখলেও যাবে না। এর চেয়ে বরং তেল চর্বি আর সোডিয়াম রিচ জাঙ্ক ফুড খাওয়া কমান। আপনার এদিকেও অনেক টাকা বাচবে আর ক্রিমের পেছনে এত কম বয়সে ছুটতে হবে না!
আমি নিজের কথা জানি, আমার মুখের সিসটিক ব্রণ তেলে ভাজা আর চিনি বাদ দেয়ার পর থেকেই কমে গিয়েছিল। আজ পর্যন্ত আমি আর ওগুলো ছুঁইনি।
৩। রোজ ২-২.৫ লিটার পানি-
মা বার বার বলে,তারপরেও পানি খান না?? আচ্ছা, এক সপ্তাহ একটু কষ্ট করে ২ লিটার পানি খান। দেখুন আপনার চুল, ত্বকে আর সাস্থ্যে কী কী পরিবর্তন আসে!! নিজেই অবাক হবেন!মানুষের দেহ ফাংশনাল থাকার জন্য ২ লিটার মিনিমাম পানি দরকার হয়। পানি কম খেয়ে ক্রিম মাখলে আসলে কাজ হয় না!
৪। চুল পড়ছে?
অনেকেই আছেন যারা চুল পড়লে সেটাকে রুপ সংক্রান্ত সমস্যা মনে করেন। কিন্তু চুল পড়া আসলে তখনি হয় যখন যখন শরীর তার দরকারি পুষ্টিটুকু পায় না। তখন সে অল্প যেটুকু পুষ্টি সে পায় সেটা চুলের পেছনে খরচ না করে দেহের অন্যান্য জরুরি কাজে ব্যয় করে। আর তখনি চুল পড়তে শুরু করে মিনারেলস আর নিউট্রিশনের অভাবে। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে পুষ্টির অভাব হলে মৃত কোষ (জানেন নিশ্চয়ই, চুল মৃত?? ) চুলের উপরে দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ ক্যাস্টর অয়েল, অলিভ অয়েল, মেহেদি, ডিম মাখলেও চুল পড়া কমবে না। (এরচেয়ে ভালো ডিমটা সিদ্ধ করে খেয়ে ফেলুন!! ) মনে রাখবেন, হঠাৎ অনেক চুল পড়া শুরু করলে এই তেল সেই তেলের পেছনে টাইম নষ্ট করবেন না। তেল আপনার পুষ্টিহীনতা দূর করবে না। এরচেয়ে ডাক্তারের কাছে যান। নিজের দেহে কী কমতি হয়েছে দেখুন। সেটা ডাক্তারের পরামর্শ মত ঠিক করার চেষ্টা করুন, অনেক তাড়াতাড়ি ফলাফল পাবেন।
৫। রোজ ৭-৮ ঘণ্টা ঘুম-
রোজ শরীরের জন্য যেটুকু ঘুম দরকার হয় সেটা না ঘুমিয়ে মোবাইল, কম্পিউটার, টিভি অথবা পড়াশোনা নিয়ে ঘুমের সময় বিজি থাকলে একে তো দেহের বৃদ্ধি প্রতিহত হয় আরেকদিকে স্কিনে বিভিন্ন প্রবলেম দেখা দেয়। ঘুম পেলে সাথে সাথে ঘুমিয়ে পড়ুন। এবং দিনে মিনিমাম ৭ ঘণ্টা ঘুমান। না ঘুমিয়ে চোখের নিচে কালো দাগ ফেলে শসার টুকরা, আই ক্রিম ঘষাঘষি করে ঝকঝকে নজরকারা চোখ আপনি জীবনেও পাবেন না।
আচ্ছা তো আজ এপর্যন্তই থাক, এই হ্যাবিটগুলো তৈরি করার চেষ্টা করুন। কিছুদিন পর টিন -এজার দের জন্য ডেইলি স্কিন কেয়ার রুটিন নিয়ে আবার লিখব। প্রথমে বিউটি হ্যাবিট নিয়ে লেখার কারণ, এগুলো ফলো না করলে স্কিন অ্যান্ড হেয়ার কেয়ার রুটিন কোন কাজে লাগবে না।
লিখেছেন – তাবাসসুম মুস্তারি মীম
ছবি – মেলিমিয়াও