বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বড় ত্রাসের নাম ডেঙ্গু। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় এর ছোবলে শত শত মানুষ মৃত্যুর মুখে পড়ছে। নবজাতকসহ যে কোন বয়সের মানুষেরই এই রোগ দেখা দিতে পারে। আজকে জানবো ডেঙ্গু রোগে কী খেলে উপকার পাওয়া যাবে এবং একজন ডেঙ্গু রোগীর দৈনিক খাদ্য তালিকা কেমন হওয়া উচিত!
ডেঙ্গু রোগীর খাদ্যাভাস নিয়ে যত কথা
ডেঙ্গু কী?
ডেঙ্গু একটি ভাইরাসজনিত রোগ। এই ভাইরাসের চার ধরনের সেরোটাইপ (serotype) থাকে। এডিস মশার মাধ্যমে এই ভাইরাস ছড়ায়। মশা কামড়ানোর (৪-১০) দিনের মধ্যে এই ভাইরাস দেহে বংশবৃদ্ধি করে রোগের সৃষ্টি করে। সাধারণত আমাদের রক্তে প্লাটিলেটের পরিমাণ থাকে দেড় লক্ষ থেকে চার লক্ষের মধ্যে। ডেঙ্গুর তীব্রতা বাড়ার সাথে সাথে এই প্লাটিলেটের পরিমাণও কমতে থাকে।
এডিস মশার জন্মস্থল
এডিস মশা শহরের আবদ্ধ জলাধার বা পানিতে বেশি বংশ বিস্তার করে। যেমনঃ টবের পানি, নারকেলের মালা, এসির নিচে জমে থাকা পানি, কমোডের পানি ইত্যাদি। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীকে কামড়ানোর মাধ্যমে এডিস মশকী প্রথমে জীবাণুবাহক হয় এবং তারপর তা অন্য কাউকে কামড়ালে লালার মাধ্যমে সেই ব্যক্তিও আক্রান্ত হয়। এভাবেই এর রোগ ছড়াতে থাকে আমাদের চারপাশে।
ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ
সাধারনত বছরের জুন-জুলাই মাস থেকে শুরু করে সেপ্টেম্বর- অক্টোবর মাসের শেষ পর্যন্ত ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা যায়। ডেঙ্গু জ্বরের নির্দিষ্ট উপসর্গ থাকে, কিন্তু সবারই যে সবসময় একই রকম উপসর্গ দেখা দিবে তা নয়। চলুন তবে দেখে নেই ডেঙ্গু জ্বরের পূর্ব ও বর্তমান লক্ষণসমূহ!
পূর্ব লক্ষণসমূহ
১. আকস্মিক জ্বর
২. প্রচন্ড মাথাব্যথা
৩. চোখ ব্যথা
৪. আলোতে অস্বস্তি
৫. কোমরে বা মেরুদন্ডে ব্যথা
৬. শরীরের হাড়ে হাড়ে ব্যথা।
৭. অরুচি
৮. ক্ষুধামন্দা
৯. বমি বমি ভাব
১০. কখনো কখনো শরীরের ত্বকে লালচে র্যাশ দেখা দেয়া।
বর্তমান লক্ষণসমূহ
তবে সম্প্রতি যে ধরনের ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব আমাদের দেশে দেখা দিয়েছে তাতে বমি, পাতলা পায়খানা এবং পেট ব্যথা ও দেখা দিচ্ছে। ইদানিংকালের এই ধরনের ডেঙ্গুর বেশিরভাগই হচ্ছে হেমোরেজিক ধরনের। যাতে রোগীর নাক দিয়ে, বমির সাথে, এমনকি পায়খানার সাথেও রক্তক্ষরণ হতে পারে। ফলে রোগীর প্লাটিলেট দ্রুত কমা শুরু করে এবং ভয়াবহ পরিণতিতে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। তাই তীব্র জ্বর হওয়ার পরদিনই এখন রক্ত পরীক্ষা করানো জরুরি। অনেকের আবার তীব্র জ্বর হচ্ছে না। সাধারন জ্বরের মতই লক্ষণ থাকে। এর সাথে পেটে ব্যথা, হালকা ঠান্ডা জ্বর ও বমি হতে পারে। আবার বমি নাও হতে পারে। এছাড়াও শরীরের ভিতর পানি জমে প্রেশার লো হয়ে যেতে পারে।
ডেঙ্গু রোগীর খাদ্যাভাস
১) পানি ও তরল জাতীয় খাবার
যেহেতু এই অসুখে শরীরের তাপমাত্রা হঠাৎ করেই অনেক বেড়ে যায়, তাই এ সময় শরীরে প্রচুর পানি ও তরল জাতীয় খাবার প্রয়োজন। চিকিৎসকদের মতে একজন ডেঙ্গু রোগীর দৈনিক ৩ লিটার বা ১২ গ্লাস পানির প্রয়োজন। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অরুচির জন্য শরীরে পানির পরিমাণে যথেষ্ঠ ঘাটতি দেখা দেয়। তাই পানির পাশাপাশি বিভিন্ন ফলের যেমনঃ আম, মাল্টা, বেদানা বা আনার, আপেল, আনারসের রস দেওয়া যেতে পারে।
২) শর্করা ও প্রোটিন সমৃদ্ধ খাদ্য
ক্ষুধামন্দা সত্বেও রোগীকে পর্যাপ্ত পরিমাণে শর্করা ও প্রোটিন সমৃদ্ধ খাদ্য যেমনঃ নরম ভাত, ডাল, ডিম, মাছ, মাংস খেতে হবে। তবে যেহেতু এ সময় অনেকের বদহজম বা গ্যাস্ট্রিকের সমস্যাও দেখা দিতে পারে তাই তারা ডিমের কুসুমের অংশটি বাদ দিতে পারে।
৩) পাতলা ঝোল
কোনভাবেই এ সময় অতিরিক্ত তেল, মশলা দিয়ে রান্না করা কোন খাবার বা বাইরের কোন ফাস্ট ফুড জাতীয় খাবার খাওয়া যাবে না। মাছ বা মাংসের ঝোল না খেয়ে সিদ্ধ করে পাতলা ঝোল করে খেতে হবে।
৪) স্যুপ
বেশি মশলা দিয়ে রান্না করা গরু বা খাসির মাংসের চেয়ে ছোট মুরগীর সহজপাচ্য ঝোল বা স্যুপ বেশি উপকারী। কয়েক রকমের সবজি সিদ্ধ করে স্যুপ অথবা টমেটো স্যুপ, চিকেন স্যুপ, কর্ন স্যুপ খেলে অনেক সময় অরুচি কাটে আবার শরীরের পানির চাহিদাও পূরণ হয়।
এছাড়া নিয়মিত খাওয়া-দাওয়ার পাশাপাশি রোগীকে পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে হবে।
রক্তের প্লাটিলেট বাড়াতে সাহায্য করে যেসব ফল ও সবজি
১. পেঁপে
এই সবজিটি প্লাটিলেট বাড়াতে সাহায্য করে। এমনকি পেঁপে পাতা থেঁতলে রস করে অনেক সময় দ্রুতই প্লাটিলেট বাড়ে। তবে গর্ভবতী ও শিশুদের ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা তা দিতে নিষেধ করেন। তাছাড়া এই বিষয়ে অনেক মত বিরোধ রয়েছে।
২. বেদানা
প্রতিদিন আনার বা বেদানার রস খেলে প্লাটিলেট দ্রুত বাড়ে।
৩. ব্রকোলি
ব্রকোলি এমন একটি বিদেশি সবজি যা রক্তের প্লাটিলেট বা অণুচক্রিকা বাড়ায়। তবে কখনোই বেশি মশলা দিয়ে রান্না না করে বরং সিদ্ধ করে খাওয়া বেশি ভালো।
একজন ডেঙ্গু রোগীর প্রতিদিনের খাদ্য তালিকা
সকালের খাবার
সকালে ( ৮/৯ টা)
পাউরুটির নরম অংশ – ২ টুকরা+ দুধ
অথবা
- পাউরুটির নরম অংশ – ২ টুকরা
- ডিম সিদ্ধ – ১ টা
- কলা- ১ টা
সকাল (১১-১১ঃ৩০) টা
বেদানার রস- ১ কাপ
আপেল- ছোট ১ টা
দুপুরের খাবার
- নরম ভাত- ১ কাপ
- ডাল- ১ কাপ
- সবজি ( সিদ্ধ করে অল্প তেল মশলা দিয়ে রান্না করা) – ১.৫ কাপ
- মাছ/ মাংস – ২ টুকরা ( ঝোল ছাড়া)
বিকেলের খাবার
সবজি ও চিকেন মিক্সড স্যুপ ( অল্প তেল-মশলা দিয়ে রান্না করা) -১ বাটি
রাতের খাবার
- নরম ভাত- ১ কাপ
- ডাল- ১ কাপ
- সবজি – ১ কাপ
- মাছ/ মাংস- ২ টুকরা ( ঝোল ছাড়া)
ডেঙ্গু প্রতিরোধে আমাদের সবার সচেতন হওয়া অত্যন্ত জরুরি। প্রত্যেকে নিজের ঘর আর আশপাশের পরিবেশ পরিষ্কার রাখলে এডিস মশা বংশ বিস্তার করতে পারবে না। সবার সুস্থতা কামনা করে আজকে এখানেই শেষ করছি। ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন!
ছবি- সংগৃহীত: সাজগোজ; ইমেজেসবাজার.কম
The post ডেঙ্গু রোগীর খাদ্যাভাস | এই রোগে ৩ বেলার খাবার কেমন হওয়া উচিত? appeared first on Shajgoj.