“গ্রীষ্মকাল আপনার কেন অপছন্দ?”-এই একটি প্রশ্ন করলেই কোন চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই যে কেউ কারণ হিসেবে ঘামাচির কথা বলে দেয়। সত্যিই গ্রীষ্মকালে একে তো গরমের জ্বালা সেই সাথে ঘামাচি হলে তা ঠিক “মরার উপর খাড়ার ঘা”-এর মত অবস্থা হয়। এই গরমে ঘামাচি হয় দেখে একে হিট র্যাশ (Heat rash)-ও বলা হয়ে থাকে । তবে চিকিৎসা বিজ্ঞানে এটি মিলিয়ারিয়া (Mliaria) নামে পরিচিত। আসুন জেনে নেই গরম আসলেই কেন ঘামাচির আক্রমণ হয়। এটি কী এক ধরনের নাকি বিভিন্ন ধরনের হয়? আর এটি হলে তার প্রতিকার কী?
গরমে ঘামাচি হওয়ার কারণ ও নিরাময়ে ১৬টি ঘরোয়া উপায়
ঘামাচি কী?
ঘামাচি এক ধরনের চর্মরোগ। নাম শুনেই বুঝতে পারছেন এর নামকরণ হয়েছে ঘাম শব্দটি থেকে। গরমের সময় আমাদের ত্বকে লাল বর্ণ ধারণ করে ফুসকুড়ির ন্যায় যা প্রকাশ পায় সেটিই হলো ঘামাচি বা হিট র্যাশ (Heat rash) । আমরা সাধারণত ফুসকুড়ি চুলকালেই তখন ঘামাচির আক্রমণ ভেবে থাকি। উল্লেখ্য যে ঘামাচি হলে আমাদের ত্বক জ্বালা করতেও পারে।
গরমে ঘামাচি কেন হয়?
আমাদের ত্বকের ঘর্মগ্রন্থির সাথে এক ধরনের জীবাণু মিশে থাকে। এই জীবাণুর নাম স্টেফ এপিডারমাইডিস। গ্রীষ্মকালে স্বাভাবিকভাবেই ঘর্মগ্রন্থি থেকে ঘাম বেশি নিঃসৃত হয়। তাই ধূলোবালিও জমে বেশি পরিমাণে। ত্বকের মৃত কোষে ধূলোবালি জমে যখন ঘর্মগ্রন্থি থেকে স্বাভাবিকভাবে ঘাম নিঃসরণ হতে পারে না তখন স্টেফ এপিডারমাইডিস-এর সংস্পর্শে এসে ঘামাচির উৎপত্তি হয়।
ঘামাচির প্রকারভেদ
এটি সাধারনত ৩ ধরনের হয়। সেগুলো হলো-
১) মিলিয়ারিয়া ক্রিস্টালিনা (Miliaria Cristalina)
এই ধরনের ঘামাচি প্রায় স্বাভাবিক হয়ে থাকে। এর তেমন কোন উপসর্গ দেখা যায় না। ত্বকের এপিডারমিস থেকে এই ঘামাচি হয়ে থাকে।
২) মিলিয়ারিয়া প্রফান্ডা (Miliaria Profunda)
এই ধরনের ঘামাচি অনেকটা মিলিয়ারিয়া ঘামাচির মতই। এটিরও তেমন কোন উপসর্গ থাকে না অর্থাৎ মিলিয়ারিয়া প্রফান্ডাও স্বাভাবিক প্রকৃতির ঘামাচি। মিলিয়ারিয়া প্রফান্ডা ত্বকের এপিডারমিস থেকে হয়।
৩) মিলিয়ারিয়া রুব্রা (Miliaria Rubra)
মিলিয়ারিয়া রুব্রা হলেই মূলত আমরা ঘামাচির যন্ত্রণা ভোগ করি। যখন অতিরিক্ত ধূলো-ময়লা জমে ঘর্মগ্রন্থি বন্ধ হয়ে ঘর্মনালীও আবদ্ধ হয়ে যায়, তখন ঘামাচিকে মিলিয়ারিয়া রুব্রার হিসেবে ধরা হয়। ত্বকে লাল লাল ফুসকুড়ি বা পানি ফোটা থাকলে বুঝতে হবে তা মিলিয়ারিয়া রুব্রার টাইপ ঘামাচি। এই ঘামাচি হলে ত্বক চুলকানো বা জ্বালা হবার সমস্যা হয়। ত্বকের গভীর থেকে অর্থাৎ ডারমিস থেকে এই ঘামাচি হয়।
ঘামাচিতে আক্রান্তের স্থান ও ক্ষতির প্রকৃতি
সাধারণত বুকে, পিঠে ফুসকুড়ি দেখা দিলেই আমরা ভাবি যে ঘামাচি হয়েছে। কিন্তু বুকে, পিঠে ছাড়াও শরীরের যেসব অংশে ভাজ পরে যেমন- কনুই, ঘাড়,কাঁধ, কুঁচকি ইত্যাদি অংশেও ঘামাচি হয়। আমরা অনেকেই মনে করি ঘামাচি হলে কোন প্রকার ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয় না। কিন্তু ঘামাচির সংক্রমণের ফলে চুলকানি ও প্রদাহের সাথে সাথে শরীর প্রচুর ক্লান্ত হয়ে যায়। কখনো কখনো বমি বমি ভাব, নিম্ন রক্তচাপ, মাথা ব্যথা, অবসাদ এমনকি হিট স্ট্রোকও হতে পারে।
ঘামাচিতে উপকারি কয়েকটি ঘরোয়া টিপস
আমাদের হাতের কাছেই রয়েছে এমন কিছু উপাদান,যা এনে দিতে পারে ঘামাচির যন্ত্রণা থেকে মুক্তি! এমন যাদুকরী কিছু টিপস জেনে নেই আসুন।
১) বরফ
ঘামাচিতে উপকার পেতে সবচেয়ে সহজ উপায় হলো যে সব স্থানে ঘামাচি আছে, সেখানে বরফ ঘষা। ঠাণ্ডা পানিও ভালো আরাম দেয় ঘামাচিতে।
২) মুলতানি মাটি
মুলতানি মাটির পেস্ট ঘামাচিতে বেশ উপকারি। এই পেস্ট তৈরি করতে লাগবে ৪/৫ টেবিল চামচ মুলতানি মাটি, গোলাপ জল ২/৩ টেবিল চামচ ও পানি পরিমাণ মত। ঘামাচির জায়গায় এই পেস্ট ২/৩ ঘন্টা রেখে পানি দিয়ে ধুয়ে ফেললে কয়েক দিনের মধ্যে ঘামচি ভালো হয়ে যাবে।
৩) বেকিং সোডা
ভাবছেন বেকিং সোডা কিভাবে ঘামাচিতে ব্যবহার করবেন? বলছি! ১ কাপ ঠাণ্ডা পানিতে ১ টেবিল চামচ বেকিং সোডা গুলিয়ে একটি পরিষ্কার কাপড় বেকিং সোডার পানিতে ভিজিয়ে তা ভালো করে নিংড়ে ঘামাচির স্থানে লাগালে বেশ উপকার পাওয়া যায়।
৪) নিমপাতা
ত্বকের যে কোনো সমস্যার সমাধান যেন নিমপাতা ছাড়া হয়ই না। ঘামাচির ক্ষেত্রেও তাই! কারণ, নিমপাতায় আছে অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল (Anti-bacterial) উপাদান যা ঘামাচি নিরাময়ে সাহায্য করে। তাই, নিমপাতার পেস্ট শরীরে লাগিয়ে তা সম্পূর্ণ শুকাতে হবে। এভাবে ৪-৫ বার দিনে ব্যবহার করতে পারলেই ঘামাচিকে বলা যাবে টা টা বাই বাই!
এছাড়াও নিমপাতার আরোও একটি চমৎকার রেমেডি বলি। ১ মুঠ নিমপাতা নিয়ে ২ কাপ পানিতে ২০ মিনিট ধরে সিদ্ধ করতে হবে। এরপর সেই পানি ঠাণ্ডা করে একটি পরিষ্কার কাপড় দিয়ে ঘামাচির জায়গায় ৫-১০ মিনিট ধরে লাগাতে হবে। এভাবে দিনে ৪/৫ বার করতে পারলে ভালো।
৫) লেবুর রস
লেবুর রসে রয়েছে শক্তিশালী অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল উপাদান, যা ঘামাচি দূর করতে বেশ কার্যকরী। ঘামাচিতে উপকার পেতে দিনে ৩/৪ গ্লাস লেবুর রস মিশ্রিত পানি পান করুন।
৬) অ্যালোভেরা জেল
অ্যালোভেরা জেল ঘামাচিতে অনেক আরাম দেয়। কয়েক দিন শরীরে নিয়মিত অ্যালোভেরা জেল ব্যবহার করলে ঘামাচি ভালো হয়ে যায়। সেজন্য অ্যালোভেরা পাতা থেকে অ্যালোভেরা জেল বের করে তা শরীরে প্রলেপ মেখে নিতে হবে। জেল আপনা-আপনি শুকিয়ে গেলে পরে ঠাণ্ডা পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে।
৭) চন্দন
চন্দন বাটা বা চন্দন গুঁড়া গোলাপজলের সাথে মিশিয়ে পেস্ট তৈরি করে ঘামাচির স্থানে কয়েকবার লাগালে কিছুদিনের মধ্যেই ঘামাচি ভালো হয়ে যাবে।
চন্দনের ম্যাজিকেল রেমেডি রয়েছে। এটি বানাতে লাগবে চন্দন বাটা/ গুড়া আর লাগবে ধনেপাতা বাটা । চন্দন ও ধনেপাতা বাটা মিশিয়ে পেস্ট তৈরি করে ঘামাচিতে লাগালে অনেক উপকার পাওয়া যায়। উল্লেখ্য যে, ধনেপাতায় আছে অ্যান্টিসেপ্টিক গুণ! আর চন্দন ঘামাচির জ্বালা ও চুলকানি দুই-ই কমায়।
৮) ফিটকিরি
পানি পরিশোধনে বা সেভিং লোশন-এর বিকল্প হিসেবে ফিটকিরি ব্যবহৃত হয় তা আমরা সবাই জানি। কিন্তু ঘামাচিতে ফিটকিরি! একথা কি সবার জানা আছে? হ্যাঁ ঘামচিতে ফিটকিরি মিশ্রিত পানি পরিষ্কার কাপড় দিয়ে লাগিয়ে কিছুক্ষণ রেখে গোসল করলে বেশ উপকার পাওয়া যায়।
৯) লাউ
আমরা জানি লাউ এমনিতেই ঠাণ্ডা একটি সবজি। ঘামাচির জন্য লাউ আগুনে ঝলসে নিয়ে তা থেকে রস বের করে কিছুদিন খেলে অনেক উপকার পাওয়া যায়।
১০) বেসন
রান্নাঘরে একটু খুঁজলেই হাতের কাছে পাবেন বেসন। বেসনের সাথে পানি মিশিয়ে পেস্ট তৈরি করে ঘামাচিতে প্রলেপ দিলে উপকার পাবেন। হ্যাঁ, অবশ্যই কিন্তু ঠাণ্ডা পানি দিয়ে ধুবেন!
১১) আলু
গরমে ঘামাচি হয়েছে? কাঁচা আলুর পেস্ট লাগান! আরে, আলু শুধু রূপচর্চায়ই ব্যবহার করা হয় না! একবার ঘামচিতে লাগিয়েই দেখুন, উপকার পাবেন।
১২) ওটমিল বাথ
ঘামাচির জন্য ওটমিল বাথ নিতে পারেন। বাথটাবে আধকাপ ওটমিল ভিজিয়ে এরপর ডুবে থেকে অপেক্ষা করুন ১৫-২০ মিনিট! ভাবছেন সবার কি বাথটাব থাকে! হ্যাঁ! তাদের বলছি, নো টেনশন! ওটমিল ভেজানো পানি ঘামাচির উপর লাগালেও হবে। এতে অসহ্যকর চুলকানি থেকে আরাম পাবেন।
১৩) তরমুজ
রসালো লাল টকটকে তরমুজ দেখলেই তৃষ্ণা বেড়ে যায় তাই না? তরমুজ তো খাবেনই, ঘামাচি থাকলে একটুখানি খাবার সময় পাল্প বের করে আলাদা করে রেখে দিন। তরমুজের পাল্প ঘামাচিতে লাগালে বেশ উপকার পাওয়া যায়।
১৪) আদা
আদার পানি ঘামাচির জন্য অনেক উপকারী। তাই, আদা গ্রেট করে পানিতে ফুটিয়ে নিতে হবে। সাবধান! গরম পানি লাগাতে যাবেন না যেন! পানি ঠাণ্ডা হলে পরেই নরম সুতি কাপড় ব্যবহার করে ঘামাচির জায়গায় লাগান।
১৫) শসা
শসা শুধু দেহকে হাইড্রেটেডই করে না, শসা ঘামাচিতেও আরামদায়ক। ঘামাচির চুলকানি দূর করতে শসা বেশ কার্যকরী। শসা পাতলা পাতলা করে কেটে তা ৩০ মিনিট সময় নিয়ে ঘামাচির স্থানে রাখুন। শীতল ভাব পাবার সাথে সাথে চুলকানি কমবে। ৩০ মিনিট পরে ঠাণ্ডা পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।
এছাড়াও শসা রস করে খানিক লেবুর রসের সাথে মিশিয়ে পাতলা পরিষ্কার কাপড় দিয়ে ঘামচিতে লাগাতে পারেন। এতে আরাম পাবার সাথে সাথে ঘামাচির নিরাময়ও হবে।
১৬) কাঁচা আম
গ্রীষ্মের সময় আমাদের সবার ঘরে ঘরে কাঁচা আম থাকে। ঘামাচি নিরাময়ে সবচেয়ে মজাদার পানীয় বোধ হয় এটি। এই পানীয় তৈরি করতে লাগবে ২টি কাঁচা আম, পানি, লবণ ও চিনি। প্রথমেই ২টি আম গরম পানিতে সিদ্ধ করে নিতে হবে। এরপর তা থেকে রস বের করে ঠাণ্ডা পানিতে পরিমাণমতো লবণ ও চিনি মিশিয়ে মজা করে খেতে থাকুন এই সুস্বাদু পানীয়! প্রতিদিন ১-২ বার করে এক সপ্তাহ পর্যন্ত পান করলে ঘামাচির জ্বালা ও চুলকানি থেকে দূরে থাকতে পারবেন খুব সহজেই!
গরমে ঘামাচি মোকাবেলায় কার্যকরী ফেইস প্যাক
অনেকেরই দেখা যায় মুখে ঘামাচি উঠে। সেক্ষেত্রে একটি ফেইস প্যাক ইউজ করতে পারেন। শুধু লাগবে ৩টি মাত্র উপাদান! তুলসি পাতা পেস্ট, কচি লাউ পেস্ট ও আতপ চাল গুঁড়া। এই ৩টি উপাদান একসাথে মিশিয়ে ব্যবহার করলে মুখের ঘামাচি কমাতে পারবেন।
গরমে ঘামাচি দূর করার প্রোডাক্টের নাম
ব্যস্ত জীবনে সময়ের অভাবে অনেকেই ঘরোয়া টিপসগুলো ব্যবহার করতে পারেন না। তাই বাধ্য হয়েই তারা পাউডারকেই তাদের সহজ সমাধান হিসেবে বেছে নেন। তাদের বলছি, হাতের কাছে রাখতে পারেন – বোরো প্লাস (Boro Plus Ice Cool), গোল্ড বন্ড পাউডার ও লোশন ( Gold Bond), ওয়াইল্ড স্টোন কুল ট্যাল্ক ( Wild Stone Cool Talk), ডুড বডি পাউডার ( Dude Body Powder) ইত্যাদি পণ্যসমূহ!
শেষ সময়ে বলে যাই ঘামাচি হলে ভুলেও যা করবেন না
- ভুল করেও নখ দিয়ে ঘামাচি চুলকাবেন না।
- অতিরিক্ত খারাপ অবস্থা হলে কোন রকম প্রসাধনী ব্যবহার করা যাবে না। তবে স্টেরয়েড মলম বা ক্যালামাইন লোশন ব্যবহার করতে পারেন।
- ঘামচি হলে নাইলনের কোনো কাপড় পরা থেকে বিরত থাকুন।
- ঘর কখনো স্যাঁতস্যাঁতে রাখবেন না। সব সময় ঘর রাখুন আলো বাতাসসমৃদ্ধ!
আর হ্যাঁ, গরমে ঘামাচি হলে ও এ থেকে পুঁজ নিঃসৃত হলে দেরি না করে শীঘ্রই ডাক্তারের পরামর্শ নিন! সুস্থ থাকুন।
ছবি – সংগৃহীত: সাজগোজ
The post গরমে ঘামাচি হওয়ার কারণ ও নিরাময়ে ১৬টি ঘরোয়া উপায়! appeared first on Shajgoj.