আজ কথা বলবো আগুন লাগলে করনীয় সম্পর্কে। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক ঘটনাগুলোর কারণে এখন আগুন শব্দটা শুনলেও যেন ভয়ে, আতঙ্কে বুক কেঁপে উঠে। নিমতলী ট্র্যাজেডি, চকবাজার অগ্নিকাণ্ড আর খুব সম্প্রতি বনানীর এই বিভীষিকাময় ঘটনা যেন বাংলাদেশের সব মানুষকেই দগ্ধ করে দিয়েছে।
যারা সরাসরি এই ঘটনাগুলোর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত তাদের এই ক্ষত প্রতিদিন প্রতিটা মুহূর্তে বয়ে বেড়াতে হলেও আমরা যারা কোনোভাবে ভাগ্যের জোরে বেঁচে গেছি তাদের মনেও কম দাগ কেটে যায় নি। এতগুলো নিরীহ প্রাণের একসাথে এই চলে যাওয়াটা কোন মানুষই স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারবে না। হঠাৎ আগুন লাগলে আমরা অনেকেই জানি না ঠিক কী করা উচিত। আবার অনেকেই আগুন লাগলে করনীয় কাজগুলো জানলেও ঘাবড়ে যাওয়ার কারণে কিংবা ভয় পেয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। হঠাৎ আগুন লাগলে কিছু কৌশল অবলম্বন করে আমরা হয়ত বেঁচেও যেতে পারি বা ক্ষতির পরিমাণ কিছুটা কমাতে পারি। আর তাই আমি আজকে আগুন লাগলে করনীয় নিয়ে এমন কিছু কথা আপনাদের সাথে শেয়ার করবো যে কাজগুলো মাথা ঠাণ্ডা রেখে করলে আগুনের ভয়াবহতা থেকে বাঁচা গেলেও যেতে পারে।
আগুনের ধরন ও নির্বাপণের উপায়
আগুন নিভাতে হলে আগে আগুনের ধরন জানতে হবে। কেননা গ্যাসের আগুন আপনি পানি দিয়ে নিভাতে পারবেন না। আগুনের উৎপত্তি, জ্বলার উপাদান… এগুলোর ভিত্তিতে আগুন সাধারনত ৪ ধরনের হয়ে থাকে-
১. সলিড ফায়ার (কাঠ, বাঁশ ইত্যাদির আগুন)
২. লিকুইড ফায়ার (তেল, পেট্রোল, ডিজেল ইত্যাদির আগুন)
৩. গ্যাস ফায়ার (গ্যাস লাইন, গ্যাসের চুলা ইত্যাদির আগুন)
৪. মেটাল ফায়ার (সোডিয়াম, পটাশিয়াম ইত্যাদির আগুন)
আগুনের ধরন বুঝে তা নেভানোর ব্যবস্থা নেয়াই হল অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা। কোথাও হঠাৎ আগুন লাগলে প্রথমেই ফায়ার সার্ভিসকে জানাতে হবে। তারপর নিরাপদ স্থানে সরে গিয়ে ফায়ার সার্ভিস আসার আগে আগুনের ধরন বুঝে তা নেভানোর চেষ্টা করতে হবে।
১. সলিড ফায়ার নির্বাপণ
পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি ছিটিয়ে এ ধরনের আগুন নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
২. লিকুইড ফায়ার নির্বাপণ
পানি দ্বারা এ ধরনের আগুন নেভানো যায় না। বরং পানি ব্যবহার করলে এ আগুন আরো দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। তাই এ ধরনের আগুনে কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস, ফোম, ড্রাই পাউডার… এগুলো বেশি কার্যকরী। তবে এগুলো কিছুই যদি না থাকে হাতের কাছে বালি থাকলে তা ছিটিয়ে দিয়েও এ ধরনের আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা যায়।
৩. গ্যাস ফায়ার নির্বাপণ
এ ধরনের আগুনে পানি একেবারেই অকার্যকর। কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস, ফোম, ড্রাই পাউডার ইত্যাদির সাহায্যেই এই আগুন নির্বাপণ করতে হয়।
৪. মেটাল ফায়ার নির্বাপণ
মেটাল ফায়ারও পানির সাহায্যে নেভানো যায় না। উপরোক্ত উপায়ে কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস, ড্রাই পাউডার, ফোম, বালি ইত্যাদির মাধ্যমেই এ ধরনের আগুন নেভানো যায়। তবে হাতের কাছে যদি কম্বল, ছালার বস্তা, ভারী কাঁথা বা তোষক জাতীয় কিছু থাকে, তবে এগুলো দিয়ে চাপ দিয়েও এই আগুন কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আর চেষ্টা করবেন এগুলো আগুনে দেয়ার আগে ভিজিয়ে নিতে। তাহলে দ্রুত কাজ হবে।
আগুন লাগলে করনীয়
এবার আসি বাসায়, অফিসে কিংবা বাইরে কোথাও হঠাৎ আগুন লাগলে একজন সচেতন মানুষ হিসেবে আমাদের করনীয় কাজগুলো কী কী।
১) মাথা ঠাণ্ডা রেখে প্রথমেই বিদ্যুতের সুইচ এবং গ্যাসের চুলা বন্ধ করার চেষ্টা করুন।
২) কাছাকাছি ফায়ার সার্ভিসের অফিসে যোগাযোগ করুন। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য- আপনার ফোনে বা হাতের কাছে সবসময় জরুরী ফোন নম্বরগুলো যেমন- নিকটস্থ পুলিশ অফিস, ফায়ার সার্ভিস, হাসপাতাল… এগুলোর নম্বর রাখুন যাতে জরুরী পরিস্থিতে সাহায্য চাইতে পারেন। অথবা ৯৯৯ এই নাম্বারে ফোন দিয়েও সাহায্য চাইতে পারেন।
৩) বাসায় আগুন লাগলে আগুনের ধরন বুঝে তা নির্বাপণের চেষ্টা করুন। গ্যাসের চুলায় বা শর্ট সার্কিট থেকে আগুন ধরলে ভেজা কাঁথা, কম্বল বা বস্তা ইত্যাদি দিয়ে ঢেকে দিলে আগুন নিভে যাবে।
৪) বাহিরে কোথাও হলে ফায়ার এক্সটিংগুইশার খুঁজে আগুনের উৎপত্তিস্থলে ব্যবহার করুন।
৫) আগুন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হলে দ্রুত নিরাপদ স্থানে সরে আসুন এবং অন্যদেরকেও সাহায্য করুন বের হয়ে আসতে।
৬) বাসা, অফিস, মার্কেট কিংবা যেকোনো জায়গাই হোক না কেন ভুলেও লিফট ব্যবহার করা যাবে না।
৭) যদি বের হয়ে আসার আগেই ধোঁয়ায় ঢেকে যায় তাহলে রুমাল কিংবা অন্য যেকোনো কাপড় দিয়ে নাক ঢেকে ফেলুন এবং সম্ভব হলে কাপড়টি অবশ্যই পানিতে ভিজিয়ে নিন। আগুনে যত মানুষ পুড়ে মারা যায় তার চেয়ে বেশি মানুষ মরে ফুসফুসে আগুন ঢোকার কারণে। ভিজা কাপড় দিয়ে নাক মুখ ভাল করে ঢেকে ফেললে বাইরের গরম বাতাস এবং ধোঁয়া শ্বাস প্রশ্বাসের সাথে ফুসফুসে খুব সহজে ঢুকতে পারে না। এতে আপনার আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা অনেক কমে যায়।
৮) গায়ের পোশাকে আগুন লেগে গেলে ভুলেও দৌড়াদৌড়ি করবেন না। এতে আরো বেশি অক্সিজেনের কারণে আগুন বেড়ে যাবে। বসে এবং মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করুন অথবা ভেজা কম্বল বা কাঁথা দিয়ে চেপে ধরুন।
৯) কোন ব্যক্তি আগুনে পুড়ে গেলে তাকে এমনভাবে শুইয়ে দিতে হবে যাতে তার পুড়ে যাওয়া অংশ খোলা থাকে এবং পুড়ে যাওয়া অংশ থেকে কাপড় সরিয়ে দিতে হবে খুব সাবধানে। পুড়ে যাওয়া অংশে যদি কাপড় আটকে যায় তবে সেটা টানাটানি না করে শরীরের অন্য কাপড় কেটে ফেলতে হবে। তারপর ঠান্ডা পানি বা বরফ পানি (না থাকলে এমনি পানি) পোড়া জায়গায় ঢালতে হবে, যতক্ষণ না পর্যন্ত চিকিৎসকের কাছে বা হাসপাতালে না নেয়া হয়। ক্ষতস্থানে কোনোভাবেই হাত দেয়া যাবে না কিংবা হাত দিয়ে ঘষা যাবে না।
১০) বৈশিষ্ট্যগত কারণে আগুন উপরের দিকে উঠে। তাই বহুতল বিল্ডিং-এর নিচের দিকের কোন ফ্লোরে আগুন লাগলে সিঁড়ির জায়গা দিয়েই আগুন উপরের দিকে ছড়িয়ে পড়ে। এরকম ক্ষেত্রে নিচে নামার সময় সতর্ক থাকুন। নিচে নামা না গেলে বিল্ডিং-এর খোলা ছাদে উঠে যাওয়া যেতে পারে। এতে ঝুঁকি কম থাকবে এবং উদ্ধার করাও সহজ হবে।
যেকোনো খারাপ পরিস্থিতিতে ঘাবড়ে যাওয়া, ভয় পাওয়া, অস্থির হয়ে যাওয়া- এগুলো আরও বেশী ক্ষতির কারণ হয়। তাই ঝুঁকি/ক্ষতি কমাতে আগুন লাগলে প্রথম ও সবচেয়ে কার্যকরী করনীয় হল- মাথা ঠাণ্ডা রেখে পরিস্থিতি বুঝে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া ও সেভাবে কাজ করা। স্বাভাবিক এবং নিরাপদ একটি জীবন আমাদের সবারই কাম্য। সবাই ভাল থাকুন, নিরাপদ থাকুন। এরকম অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে যার যার জায়গা থেকে সচেতন থাকুন।
ছবি- সংগৃহীত: সাজগোজ
The post আগুন লাগলে করনীয় | ঝুঁকি ও ক্ষতি কমাতে ১০টি কার্যকরী কৌশল appeared first on Shajgoj.