৪০-৪৫ বছর বয়স পার হলেই নারীদের মধ্যে বিশেষ কিছু পরিবর্তন দেখা দেয়। এই পরিবর্তন শারীরিক এবং মানুষিক দুই রকমেরই হয়ে থাকে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যে পরিবর্তন আসে তা হল ঋতুস্রাব বা মাসিক অনিয়মিত হয়ে যায় এবং আস্তে আস্তে একসময় তা একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। এই অবস্থাকেই মেনোপজ বা রজোবন্ধ বলা হয়।
আসুন জেনে নেই এই মেনোপজ সম্পর্কে জরুরী কিছু তথ্য।
মেনোপজ বা রজোবন্ধ কী?
নারীর দেহে এস্ট্রোজেন (Estrogen) ও প্রজেস্ট্রেরন (Progesterone) নামের দুই হরমোনের প্রভাবেই মাসিক চক্র (Period Cycle) চলতে থাকে। ৪০ থেকে ৪৫ বছর বয়সের পরে এই এস্ট্রোজেন ক্ষরণ ধীরে ধীরে কমতে থাকে। যার ফলে কমতে শুরু করে ঋতুস্রাবের পরিমাণ, এই অবস্থাকে বলা হয় পেরি-মেনোপজ (Perimenopause)। এই সময় বিভিন্ন রকম লক্ষণের মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি যে মেনোপজ আসছে। যেমন, অনিয়মিত ঋতুস্রাব (Irregular menstruation), ইনসমনিয়া (Insomnia), শুকনো ভ্যাজাইনা (Vaginal Dryness), ওজন বেড়ে যাওয়া (Weight gain), অবসাদ (Fatigue), উদ্বেগ (Anxiety), স্মৃতিভ্রংশ (Dementia), লিবিডো (Libido) বা যৌন আকাঙ্ক্ষা কমে যাওয়া। চোখ, মুখ ও চামড়ায় শুষ্কতাও লক্ষ্য করা যায়। তারপর যখন এস্ট্রোজেন ক্ষরণ একেবারে বন্ধ হয়ে যায় তখন মাসিক ও একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। শুরু হয় নারীর জীবনের অম্ল মধুর এক নতুন অধ্যায় মেনোপজ। ১২ মাস টানা পিরিয়ড না হলেই বুঝতে হবে মেনোপজের প্রারম্ভ৷ একশো জনের মধ্যে ১ জন মহিলার ৪০ বছর ছোঁয়ার আগেই প্রিম্যাচিওর মেনোপজ হয়ে যায়৷
মেনোপজের উপসর্গসমূহ
১) মেনোপজ এর সবথেকে প্রচলিত লক্ষণ হল হট ফ্লাশ (Hot Flash)। হঠাৎ করে মনে হবে শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে গরম হল্কা বের হচ্ছে। এর স্থায়িত্ব সাময়িক। কিছুক্ষণ পর আবার তাপমাত্রা স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
২) আরেকটি উল্লেখযোগ্য লক্ষণ হল নাইট সোয়েট (Night sweat), মানে মাঝে মাঝে রাতে ঘুম ভেঙে যেতে পারে আর সারা শরীরে ঘাম হতে পারে।
৩) এ সময় খুব জলদি হাঁপিয়ে ওঠেন নারীরা। সবসময় যেন একটা ক্লান্তি ভর করে থাকে।
৪) ডিপ্রেশন বা মুড সুইং হয় ও অবসাদ দেখা দেয়।
৫) মন মেজাজ খিটখিটে হয়ে থাকে।
৬) অস্থিরতা বা পালপিটিশন বেড়ে যায়।
মেনোপজের প্রভাব
মেনোপজের ফলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যেই সমস্যাটি হয় তা হল, যার মেনোপজ হয় সে ভাবে যে তার জীবন শেষ! মানসিকভাবে সে ভেঙে পড়ে। একা থাকলে অনেকে মনে করেন তার সব শেষ হয়ে গেল। তবে আধুনিক নারীদেরতো আর মেনোপজের কারণে প্রতিদিনের কাজ ফেলে বিলাপ করার সময় নেই। তাই এ সময়ের শারীরিক পরিবর্তনগুলোর সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে বেশ বেগ পেতে হয় তাদের। আর তাদের জন্যই এ সময় কী ধরনের পরিবর্তন এবং সমস্যা হতে পারে আর এর সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার বিষয়গুলো জানা থাকা জরুরি। মেনোপজ সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে নারীর হাড়ে। একে বলে অস্টিওপোরেসিস (Osteoporosis) বা হাড়ের ক্ষয়।
মেনোপজের কারণে শরীরে হরমোনের অভাব দেখা দেয় যার ফলে হাড়ের ক্যালসিয়াম কমতে শুরু করে। তাই হাড় দুর্বল হয়ে যায়। আর খুব সামান্য আঘাত বা হোঁচটেও বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারে। বিশেষ করে কোমর এবং কোমরের নিচের দিকের হাড় খুবই দুর্বল হয়ে যায়। তাই বেশিরভাগ নারীই কোমরের ব্যথায় ভুগে থাকেন। আবার এই হরমোন কিন্তু হার্টকেও সুরক্ষিত করে রিপ্রোডাকটিভ বয়সে। এই জন্য মেয়েদের হার্টের রোগ কম হয়। কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রেখে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমায়। তবে যখন বয়স হয়ে যায়, এসট্রোজেন কমে যায়, তখন তার ঝুঁকি থাকে হার্টের সমস্যা হওয়ার।
মেনোপজের শারীরিক উপসর্গগুলো বেশ অস্বস্তিকর, তবে মনের উপর এর প্রভাব আরও বেশি। অনেক নারীই শারীরিক পরিবর্তনগুলো চট করে মেনে নিতে পারেন না। আর এ কারণে নানান ধরনের মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। অনেক নারীই ভাবতে শুরু করেন স্বামী এবং সন্তানদের কাছে তিনি অনাকাঙ্ক্ষিত একজন। সেখান থেকে তৈরি হয় বিরক্তি ও ডিপ্রেশন। অল্পেই রেগে যাওয়া, খিটখিটে মেজাজ- নিজেকে সামলাতে না পারলে এগুলোর পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে। আবার কোনো কোনো নারীর মধ্যে অতিরিক্ত সন্দেহপ্রবণতা দেখা যায়। নিজেকে অসহায় ভাবতে শুরু করা এ সময় সবচেয়ে গুরুতর লক্ষণ। আর এসব কারণে দৈনন্দিন কাজেও ব্যাঘাত ঘটে।
মেনোপজের সময় করনীয়
হট ফ্লাশ বা নাইট সোয়েট, ডিপ্রেশন, ঘুমের সমস্যা যদি বেশি দিন চলে, তাহলে এর থেকে রেহাই পেতে হরমোন ট্রিটমেন্ট করানো যেতে পারে। এস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন হরমোন কম ক্ষরণ বা ক্ষরণ না হওয়ার কারণেই মেনোপজ হয়। এই হরমোনগুলো প্রতিস্থাপন করা হলেই সমস্যার অনেকটা সমাধান করা যায়। তবে এটি যথেষ্ট সময় সাপেক্ষ এবং খরচ সাপেক্ষ একটি চিকিৎসা প্রক্রিয়া। ত্রিশের পর থেকেই মেয়েদের খাবারে ক্যালসিয়াম সাপ্লিমেন্ট-এর পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়া উচিত। মেনোপজের কারণে শরীরে ক্যালসিয়ামের ঘাটতি দেখা দেয়। তাই এ সময় খাবারের ব্যাপারে বিশেষ নজর দিতে হবে। আর মাঝ বয়সে সব ধরনের খাবারও খাওয়া যায় না। তাই নিয়ম করে পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। তাছাড়া ভিটামিন বি কমপ্লেক্স-ও খেতে হবে।
পরিবারের সচেতনতা ও সহযোগীতা
এ ধরনের পরিস্থিতিতে স্বামী এবং পরিবারের সহযোগিতা খুবই জরুরি। স্বামী যদি স্ত্রীর মানসিক অবস্থা সম্পর্কে কিছুটা বুঝে তাকে সাহায্য করেন, তাহলে মানসিক অস্থিরতা কিছুটা কম হয়। সারাদিন পর একসঙ্গে গল্প করা বা পছন্দের জায়গায় ঘুরতে যাওয়া- এ ধরনের মানসিক পরিস্থিতিতে খুবই কার্যকর। সেই সাথে নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া এবং রেগ্যুলার চেকআপ-এ থাকাটাও জরুরী। তাহলে বিভিন্ন শারীরিক এবং মানসিক পরিবর্তন সম্পর্কে আগে থেকেই সতর্ক থাকা যাবে।
ছবি- সংগৃহীত: সাজগোজ; ইমেজেসবাজার.কম
The post মেনোপজ | নারীর জীবনের নতুন অধ্যায় appeared first on Shajgoj.