বিয়ের দিনটি হয় একটি মেয়ের জীবনের সবচেয়ে বিশেষ দিনগুলোর মধ্যে একটি। এদিন বিয়ের কনেই হচ্ছে আসরের মধ্যমণি। তাই সবার চোখ থাকে সেদিন বিয়ের কনের দিকে। আর প্রতিটা মেয়েই চায় বিয়ের দিন যেন তাকেই সবচেয়ে সুন্দর দেখায়। কিন্তু বিয়ের আগের শপিং, পড়াশোনা বা অফিসের কাজ সেরে রাখা, নানান ছোটাছুটিতে দেখা যায়, নিজের যত্ন নেয়ার সময় করে উঠতে পারেন না অনেকেই। আবার বিয়ের আগে কনের প্রস্তুতি কিন্তু একটা এলাহি ব্যাপার ! অনেকে মনে করে বিয়ের এক সপ্তাহ আগে, পার্লারে গিয়ে পা থেকে মাথা পর্যন্ত একটা ফুল ব্রাইডাল প্যাকেজ করে নিলেই হবে। কিন্তু সেটা করলে কিন্তু আসলে টাকা নষ্ট ছাড়া খুব বেশি উপকার আপনি পাবেন না। নিজের যত্ন নেয়ার প্রস্তুতি শুরু করতে হবে এক মাস আগে থেকেই। তাহলেই দেখবেন, বিয়ের দিন আপনি শারীরিক, মানসিক… মোটকথা সবদিক দিয়েই তৈরি হয়ে আছেন।
বিয়ের আগে কনের প্রস্তুতি কেন দরকার? চলুন জেনে নিই ধাপে ধাপে…
(১) মুখের মেকআপ
যে দিন বিয়ে ঐ দিন একটা ভারি মেকআপ মুখে লাগানো হয়। সেই মেকআপ প্রায় আট ঘণ্টা পর্যন্ত মুখে রাখতে হয়। প্রথমত, এই ভারি মেকআপ লাগানোর জন্য একটা ফ্ললেস ক্লিনের মুখ দরকার, যেখানে খুব সুন্দরভাবে মেকআপ বসানো যাবে। দ্বিতীয়ত, একটা দীর্ঘ সময় এই মেকআপ মুখে রাখার কারণে যাতে বিয়ের পরদিনই মুখে একটা পিম্পল না আসে, সেজন্য মুখের ত্বককে ভালোভাবে প্রস্তুত করে নেয়া দরকার।
(২) ডার্ক সার্কেল নিয়ে সাবধানতা
খুব স্বাভাবিকভাবেই বিয়ের আগে বেশ স্ট্রেস যায়। অনেক সময় দেখা যায়, হবু কনে সারা রাত জেগে হবু বরের সাথে কথা বলেন! এসব কারণে চোখের নিচে কালি পড়ে যায়। আর ডার্ক সার্কেল থাকলে চোখের মেকআপ যত বড় মেকআপ আর্টিস্টকে দিয়েই করান না কেন, কোনভাবেই ফুটে উঠবে না।
(৩) চুলের যত্ন
বিয়ের দিন চুল সেট করতে যে পরিমাণ হেয়ার স্প্রে আর হিট দেয়া হয়, সেটা বোধ করি সারা জীবনে আর কখনই হয় না, এক যদি না আপনি মিডিয়া জগতের কেউ হয়ে থাকেন। তাই বিয়ের দিন চুলের ওপরে যাওয়া ঝড় সামলাতে চুলটাকে আগে থেকেই একটু স্বাস্থ্যকর (তেল, শ্যাম্পু ব্যবহারের মাধ্যমে) করে তুলতে পারলে দেখবেন, হেয়ার সেটিং-এর ধকল সারিয়ে নেয়া অনেকটাই সহজ হয়ে গেছে।
(৪) শারীরিকভাবে প্রস্তুতি
বিয়ের দিন শারীরিকভাবে প্রস্তুত থাকাটা খুব দরকার। ওজন অবশ্যই প্রয়োজন হলে কমাবেন, তবে সেটা করতে গিয়ে গ্যাস্ট্রিক বাধানো যাবে না। তাই খাওয়ার রুটিনটাও মাস খানেক আগে থেকেই ঠিক করে নেয়া প্রয়োজন। আর অন্য যেকোনো শারীরিক সমস্যা থাকলে সেটাও ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে এক মাসে অনেকটাই সারিয়ে ফেলা সম্ভব।
অনেক কথা হল, এবার আসি মূল প্রসঙ্গে। কিভাবে একমাসের মধ্যে ৪টি ধাপে আপনি বিয়ের সম্পূর্ণ প্রস্তুতি নেবেন।
বিয়ের আগে কনের প্রস্তুতি থাকা কেমন হওয়া চাই? এ নিয়ে বিস্তারিত জানাবো বিয়ের এক মাস (৪ সপ্তাহ) আগে থেকে কনের প্রস্তুতি কেমন হবে তার মধ্য দিয়ে।
১. প্রথম সপ্তাহে কী করবেন?
এই সপ্তাহের মধ্যে যাবতীয় প্রয়োজনীয় কেনাকাটা সেরে ফেলুন। ব্লাউজ, সালওয়ার-কামিজ বানাতে দিয়ে দিন, মাপের এদিক-সেদিক হলেও যাতে সেটা ঠিক করানোর সময় থাকে। আপনার মেকআপ কিট এবং বিউটি কিট-এ যা কিছু প্রয়োজন কিনে ফেলুন। সামনের এক মাসে আপনার সৌন্দর্যচর্চায় কী কী লাগবে, সেটার একটা লিস্ট করে আনিয়ে ফেলুন। আর অবশ্যই একটা চার্ট বানিয়ে ফেলুন। ডাক্তারের কাছে যেতে হলে সেটাও এই সপ্তাহে করবেন। আর এই সপ্তাহ থেকে দিনে আড়াই লিটার পানি খাওয়া শুরু করবেন।
শারীরিকভাবে ফিট থাকার জন্যে একটা সেভেন ডে চ্যালেঞ্জ যেটা আমি নিজে করতে যাচ্ছি, সেটা শুরু করে দিতে পারেন, এই সপ্তাহে। মাত্র সাত মিনিটের সেশন। Lucy Wyndham–Read-এর ইউটিউব চ্যানেল-এ সাত মিনিটের বেশ কিছু ওয়ার্কআউট সেশন আছে, আপনার যেটা প্রয়োজন সেটা বেছে নিয়ে শুরু করে দিন। আরেকটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কথা বলা হয় নি, এই সপ্তাহ থেকে ৫০+ কোন ভালো মানের সানস্ক্রিন ব্যবহার করা শুরু করে দিন।
২. দ্বিতীয় সপ্তাহে কী করবেন?
বিয়ের আগে ত্বকের যত্ন মানে পুরো শরীরকেই কিন্তু বোঝায়। তবুও প্রধান ফোকাস থাকবে নিচের বিষয়গুলোতে-
- সম্পূর্ণ ত্বক
- চুল
- চোখ
- ঠোঁট
- নখ
- দাঁত
প্রথমেই আসি ত্বকের যত্ন নিয়ে, সাজগোজে যদিও আপনি চুল, ত্বক নিয়ে আলাদা আলাদা অনেক লেখা একটু খুঁজলেই পাবেন, তবুও একটা সামারি এখানে দিচ্ছি আমি, প্রয়োজনে পরে আরেকটি লেখায় আমি বিশদ করে লিখবো।
১) ক্লিঞ্জিং, টোনিং ও ময়েশ্চারাইজিং (Cleansing, Toning & Moisturizing)
বিয়ের আগে স্কিনকে ভালোভাবে প্রিপেয়ার করে নিতে হলে এই ৩টি জিনিস আপনাকে নিয়মিতভাবে করে যেতে হবে। নিজের স্কিনের ধরন বুঝে ন্যাচারাল প্রোডাক্ট বা ভালো মানের কোন প্রোডাক্ট ব্যবহার করে এটি করবেন। বিয়ের আগে কোন নতুন ধরনের প্রোডাক্ট ব্যবহার বা এক্সপেরিমেন্ট করতে যাবেন না।
২) এক্সফলিয়েশন (Exfoliation)
খুবই জরুরি একটা বিষয়। এটা না করলে মেকআপ বসবে না, হাতে মেহেদি দিলে ভালো লাগবে না বা ব্লাউজের ক্ষেত্রে পিঠের খোলা অংশটা খুবই বাজে দেখাবে। এটা পারলে প্রতিদিন করুন। তবে মুখে দুইদিন অন্তর করবেন। আর এক্সফলিয়েশন-এর পরে খুব ভালোভাবে ময়েশ্চারাইজ করাটা কিন্তু মাস্ট।
৩) ফেসিয়াল এবং হেয়ার স্পা (Facial & Hair Spa)
এটা যদিও বিয়ের প্রায় তিন মাস আগে থেকেই শুরু করা উচিত, তবে যদি না করে থাকেন তাহলে দেরি না করে আজই শুরু করে দিন। তবে চেষ্টা করবেন ভালো পার্লারে যেতে, যারা স্কিন টেস্ট করে ফেসিয়াল করে দেবে। বিয়ের আগের ম্যাক্সিমাম তিনবার করতে পারেন। তবে শেষেরটা বিয়ের এক সপ্তাহ বা খুব বড় জোর ৪-৫ দিন আগে করাবেন। পাশাপাশি ধরে নিয়মিত যত্নতো থাকছেই। পার্লার থেকে বিয়ের ১৫ দিন আগে একটা হেয়ার কাট করিয়ে নেবেন। আর দুবার হেয়ার স্পা। বাকিটা বাসায় নিজেই করতে পারবেন।
৪) মেনিকিউর এবং পেডিকিউর (Manicure & Pedicure)
বিয়ের দিন বা তার আগে পরে সবাই হাতের এনগেজমেন্ট রিং দেখতে চায়। তখন হাতে যদি ঠিকঠাক ম্যানিকিউর না করা থাকে, তাহলে আংটি যতই উজ্জ্বল হোক, ভালো কিন্তু দেখাবে না। ম্যানিকিউর ও পেডিকিউর-টা চাইলেই আপনি বাসায় বসে করতে পারবেন। তবে বিয়ের কয়েক দিন আগে একটা ফ্রেঞ্চ ম্যানিকিউর-পেডিকিউর করে নিলে বেশ ভালো দেখাবে। আর পা ফাটার সমস্যা থেকে থাকলে এখন থেকেই যত্ন নেয়া শুরু করুন, যাতে বিয়ের দিন বরের বাড়ীতে দুধে আলতায় পা রাঙানোর সময় নরম কোমল পায়ের ছাপ পড়ে সেখানে।
৫) জিম এবং ডায়েট (Gym & Diet)
বিয়ের আগে যদি ওজন কমানোর থাকে, তাহলে এখনি শুরু না করলে কিন্তু খুব একটা ফল পাবেন না। তাই আপনার প্রয়োজন বুঝে জিম ইন্সট্রাক্টর-এর সাথে কথা বলে এক্সারসাইজ শুরু করুন, প্লাস ডায়েট চার্ট বানিয়ে, নিয়ম করে খাওয়া-দাওয়া করুন। ডায়েট চার্টে প্রচুর পানি, প্রোটিন, ফল এবং সবজি রাখবেন, কারণ ন্যাচারাল গ্লো কিন্তু ভেতর থেকেই আসে।
৩. তৃতীয় সপ্তাহে কী করবেন?
১) মেডিটেশন এবং রিলাক্সিং
এই সময়ে এসে নার্ভাস হয়ে যাওয়া খুব স্বাভাবিক, তাই নিয়মিত মেডিটেশন করবেন। চাইলে ইয়োগা করতে পারেন। ঘুম থেকে উঠে ঘুমুতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সময়টাকে একটা রুটিন-এ বেঁধে ফেলুন।
২) বাইরে যাওয়া কমিয়ে দিন
বিয়ের ৭ দিন আগে থেকেই বাইরে যাওয়া যতটা সম্ভব কমিয়ে দিন। খুব দরকার হলে রাতে যাবেন। আর যাদের বাইরে যাওয়াটা ম্যান্ডেটরি তারা অবশ্যই স্কার্ফ, ছাতা, সানগ্লাস, সানস্ক্রিন- ব্যবহার করবেন।
৩) বিউটি রেজিম
দ্বিতীয় সপ্তাহের মত বিউটি রেজিম মেনে চলুন। রোজ রাতে ঘুমুবার আগে হাতে পায়ে ভালো করে অলিভ অয়েল ম্যাসাজ করে নেবেন।
৪. চতুর্থ সপ্তাহে কী করবেন?
১) ওয়াক্সিং: ওয়াক্সিং-টা এই সপ্তাহের শুরুতেই করিয়ে নেবেন।
২) গ্লো ফেসিয়াল: ভালো কোন পার্লারে গিয়ে খুব সুদিং হাইড্রেটিং একটা ফেসিয়াল করাবেন।
৩) আইব্রো প্লাক: আইব্রো প্লাক করবেন বিয়ের ঠিক দু’দিন আগে, যাতে কোন র্যাশ না থাকে।
৪) বিউটি রেজিম: মেনে চলবেন আগের মতন। হট অয়েল ট্রিটমেন্ট নেবেন ঘরেই।
বিয়ের আগের দিন করনীয়
- প্রচুর পানি খাবেন।
- লিপ স্ক্রাবিং করতে ভুলবেন না।
- খুব ভালো একটা শাওয়ার নেবেন।
- সময় মত ঘুমুবেন। বিয়ের আগের দিন খুব ভালো একটা ৮-১০ ঘণ্টার ঘুম দরকার।
প্রচুর কথা হল, এখন সবকিছু কিভাবে মনে রাখবেন? একটা চার্ট করে নিন, পুরো একমাসের। যেখানে, কবে কী করবেন, পার্লারে যাওয়ার ডেট, ফেসিয়াল-এর চার্ট, মেহেদী দেয়ার ডেট… বিয়ের আগে কনের প্রস্তুতি রিলেটেড সব লেখা থাকবে। মানে অনেকটা বিয়ের আগে কনের প্রস্তুতি নেয়ার চেকলিস্ট-এর মত! খুব ভালো হবে, যদি কাছে কোন বান্ধবী বা বোনকে এসময় পাশে রাখতে পারেন। চিন্তার কিচ্ছু নেই। অনেক অনেক শুভ কামনা রইলো হবু কনেদের জন্য। শুভ হোক, আপনাদের নতুন জীবন। ভালো থাকুন, সুন্দর থাকুন।
ছবি- সংগৃহীত: সাজগোজ; ইমেজেসবাজার.কম
The post বিয়ের আগে কনের প্রস্তুতি | ১ মাসে কিভাবে হবেন তৈরি? appeared first on Shajgoj.