“অগ্রহায়ণ বলছে স্বয়ং-নবান্ন এই এলো রে!”– হ্যাঁ, এখন চলছে অগ্রহায়ণ। আমন ধানের মৌ মৌ গন্ধে সুরভিত চারপাশ। ঘরে ঘরে নবান্নের উৎসব আজ প্রতি পরিবারে। তবে পৌষ পেরিয়ে মাঘ এলেই শীতকালের আসল পরিচয় পাওয়া যায়। দিনের বেলাতেও কুয়াশাচ্ছন্ন আবছায়ায় শীতকাল জেঁকে বসে। তবে পৌষের প্রাণের ডাকে সাড়া দিয়েই হিম হিম শীতের সকল আয়োজন শুরু হয়ে যায়। শীতকালের আয়োজন মানেই যে পিঠাপুলি!
পিঠাবিহীন শীতকাল যেন কল্পনাই করা যায় না।তাই শীতকালকে পিঠার মৌসুমও বলা হয়ে থাকে। অপরদিকে বাঙালির লোকইতিহাস-ঐতিহ্যে পিঠাপুলি একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই পিঠাপুলির প্রায় ১৫০ টি রকমভেদ থাকলেও আমাদের বাংলাদেশে বর্তমানে মোটামুটি ৩০ প্রকারের পিঠার প্রচলন দেখা যায়।
প্রতিটি পিঠা শুধু স্বাদেই অনন্য নয়, এদের এক একটি উপকরণে পরম মায়ার পরশ মাখা থাকে। গাঁয়ের কিশোরী মেয়ে বা লাজুক বধূর আলতা রাঙা পায়ে ঢেঁকি ভাঙানির গান এনে দেয় ধবধবে চালের গুঁড়া।
শীতের আদুরে রোদে উঠোনের এক কোনে দু-তিন জনের গল্পে গল্পে নারকেল কুড়ানো, ঝাপসা মতন কুয়াশা চাদর ভোরে জোগাড় করা খেজুর রস, সেই নতুন রসের থেকে তৈরি পাটালি গুড় আর খাঁটি ঘন দুধ, তেল ইত্যাদি সব উপকরণের সাথে মায়ের যত্ন আর ভালোবাসা যোগ হলেই মনকাড়া, নজরকাড়া অমৃত স্বাদের পিঠা পুলি জিভে জল আনে।
বেশিরভাগ পিঠা মিষ্টি হলেও সেই মিষ্টি স্বাদ একইরকম নয়। এদের কোনটা রেখে কোনটা বেশি মজাদার তা বলা কঠিন হয়ে পরে। বলতে পারেন পিঠা পুলিও যেন তাদের নিজেদের মধ্যে স্বাদের প্রতিযোগিতা করে।
শুধু স্বাদই নয়, নামেও এদের বিশেষত্ব রয়েছে। যেমন- গরম ভাপে তৈরি ভাপা পিঠা, সুন্দর নকশা আঁকা হয় বলে নকশী পিঠা, দুধে ভিজে চিতই হয় দুধ চিতই, লবঙ্গের ঘ্রানে সাজে লবঙ্গ লতিকা, মুঠ পাকিয়ে সেদ্ধ দিলেই মুঠোপিঠা।
আবার গোলাপ ফুলের আকারে হল গোলাপ পিঠা। এছাড়াও মুখে রোচে পাটিসাপটা, কুলি, দুধ কুলি, চিতই, তেলেভাঁজা, রাজভোগ, ঝিনুক পিঠা, ঝুড়ি পিঠা, মাংস পিঠা, চাপড়ি পিঠা, ছিট পিঠা, কলা পিঠা, পাকন, আন্দশা, মাল্পয়া, সেমাই পিঠা, বিয়ের বিশেষ বিবিয়ানা, মেরা পিঠাসহ আরও কত কী!
পিঠা- পুলির দেশ বাংলাদেশ। তাই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পিঠার স্থান যেন দেশীয় ঐতিহ্যের স্বকীয়তা ধরে রাখে। পিঠা ধরে রাখে আত্মীয়তার বন্ধন। আত্মীয়-স্বজনদের বাড়ি পিঠা পাঠানোর রীতি… নিয়ম তাই পালন হয়ে আসছে বহুকাল ধরে।
আজকের ব্যস্ত জীবনে শহরের ইট-কাঠের খাঁচায় আর সেই গ্রামের মেঠোপথ ধরে ঝাপসা কুয়াশায় পাওয়া যায় না সকালের খেজুরের রস। সূর্যের কোমল মিষ্টি রোদের হাসিতে হয় না খাওয়া রসের পিঠা।
তবে নাড়ির টান যে আজও অনুভূত হয় সংস্কৃতির তরে। তাই শহরবাসীর পিঠার চাহিদা মেটাতে অলিতে গলিতে, রাস্তার মোড়ে, বাসস্ট্যান্ড ও বাজারে বসেছে ছোট ছোট পিঠার দোকান।
এছাড়াও প্রতি বছরই শীতের মৌসুমে ঢাকাসহ প্রায় সব জেলা শহরগুলোতেও বিভিন্ন পিঠা উৎসবে মুখরিত হয় অনেকেই। গলির মোড় থেকে পিঠা উৎসব… এভাবেই শহরবাসী শীতের পিঠার স্বাদ নেয়।
পিঠার দোকানে প্রভাবিত হয়ে ক্রমেই আমাদের নিজ বাড়িতে পিঠা তৈরির ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে। পিঠা আমাদেরই ঐতিহ্য, আমাদেরই সংস্কৃতি। এই ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা তাই আমাদেরই করতে হবে। কি ভাবছেন? কুটুম বাড়ি পিঠা পাঠাতে হবে যে! তড়িঘড়ি কাজে লেগে পড়ুন! সবাইকে নবান্ন ও শীতের আগাম শুভেচ্ছা!