আমাদের প্রায় সবার রান্নাঘরেই উপস্থিত থাকে এ দারুণ সুগন্ধি আর ঔষধি গুণযুক্ত মশলাটি – যার নাম দারুচিনি। ইংরেজিতে যাকে বলা হয় Cinnamon.
মাংস রান্নায় হোক , খিচুড়ি রান্নায় হোক, পায়েশ বা অন্য কোন ডেজার্ট রান্নায় হোক , কিংবা একটু লিকার চা করতে হোক, এক টুকরো দারুচিনি কিন্তু আমাদের লাগেই । রান্নাঘরের এই অতি প্রয়োজনীয় মশলাটির ঔষধি গুণের কথা ও কিন্তু আমাদের অনেকেরই অজানা । চলুন তাহলে দেখে নেয়া যাক সুস্বাস্থ্য রক্ষায় দারুচিনির কি কি ভূমিকা আছে -
(১) টাইপ ২ ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সহায়ক
দারুচিনি ইনসুলিন রেসিসট্যান্স কমায় এবং ফাস্টিং ব্লাড সুগার লেভেল প্রায় ২৯ শতাংশ পর্যন্ত কমাতে সক্ষম বলে গবেষণায় জানা গিয়েছে। দারুচিনি সরাসরি মাসল সেলগুলোতে কাজ করে এবং রক্তপ্রবাহ থেকে চিনিকে সরাতে বাধ্য করে।
(২) রক্তের খারাপ কোলেস্টেরলকে নিয়ন্ত্রণ করে
দারুচিনিতে আছে প্রচুর অ্যান্টি অক্সিডেন্টস। এটি রক্তের খারাপ কোলেস্টেরলকে কমিয়ে রক্তকে পরিশোধিত করতে সহায়তা করে। এবং রক্তচাপকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করে।
(৩) ওজন কমাতে সহায়ক
প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে আধা গ্লাস কুসুম গরম পানিতে এক চা চামচ দারুচিনি মিশিয়ে পান করুন। দারুচিনি রক্তের ব্লাড সুগারকে নিয়ন্ত্রণ করে, খারাপ কোলেস্টেরলকে কমায় এবং আপনার মেটাবোলিজমকে বাড়িয়ে আপনার ওজন কমাতে সহায়তা করবে।
(৪) আলঝেইমার্স এবং পার্কিনসন রোগের চিকিৎসায় সহায়ক
দারুচিনি নিউরনকে সচল হতে সাহায্য করে এবং মোটর ফাংশনকে ত্বরান্বিত করে, তাই আলঝেইমার্স এবং পার্কিনসন রোগীদের ডায়েটে দারুচিনি রাখা ভালো বলে গবেষণায় জানা গিয়েছে।
(৫) দারুচিনিতে আছে অ্যান্টি-ফাঙ্গাল, অ্যান্টি-ব্যাক্টেরিয়াল,অ্যান্টি-ভাইরাল প্রোপার্টি
দারুচিনিতে রয়েছে অ্যান্টি-ফাঙ্গাল, অ্যান্টিব্যাক্টেরিয়াল এবং এমনকি অ্যান্টি-ভাইরাল প্রোপার্টি, যার ফলে আপনি যখন রান্নায় দারুচিনি ব্যবহার করবেন তখন খাবারের মাধ্যমে এ জাতীয় কারণগুলো থেকে হওয়া অসুখবিসুখগুলো ছড়াতে পারবে না। সোজা কথায় বলতে গেলে, দারুচিনি রোগ প্রতিরোধে সহায়ক।
(৬) দারুচিনি ব্যথা উপশমে সহায়ক
মাথাব্যথা, হাড়ের জয়েন্টে ব্যথা, মাসল পেইন, মেয়েদের মাসিককালীন ব্যথা উপশমে দারুচিনি দারুণ ভূমিকা রাখতে পারে। কারণ দারুচিনিতে আছে অ্যান্টি ইনফ্ল্যামেটোরি উপাদান।
(৭) দাঁত আর মাড়ির ব্যথায় দারুচিনি
যাদের দাঁত আর মাড়ির ব্যথার সমস্যা আছে তারা ব্রাশ করার সময় পেস্টের উপর এক চিমটি দারুচিনির গুঁড়ো দিয়ে তারপর ব্রাশ করুন। ব্যথা কমে যাবে।
(৮) নিঃশ্বাসের দুর্গন্ধ দূর করতে দারুচিনি
প্রতিদিন দু’বেলা ব্রাশ করার পর ও মুখে দুর্গন্ধ? এক টুকরো দারুচিনি চিবান, অথবা আধ গ্লাস কুসুম গরম পানিতে আধ চা চামচ দারুচিনির গুঁড়ো মিশিয়ে খেয়ে ফেলুন। খেতে না চাইলে শুধু গড়গড়া ও করতে পারেন। নিঃশ্বাসের দুর্গন্ধ বিদায় হবে।
সৌন্দর্যচর্চায় দারুচিনি
দারুচিনিতে অ্যান্টি-ব্যাক্টেরিয়াল উপাদান থাকায় সবার স্কিনে এটা স্যুট নাও করতে পারে। সাধারণভাবে স্কিনে দারুচিনির গুঁড়ো ব্যবহার করে হালকা জ্বলুনি (Sting) হতে পারে, তবে সেটা ৩০-৪০ সেকেন্ডের জন্য। তারপর স্বাভাবিক লাগার কথা। কিন্তু কারো যদি তার চেয়ে জ্বলুনি অনুভূত হয়, তাহলে সাথে সাথে স্কিনে পানির ঝাপটা দিয়ে ধুয়ে ফেলবেন। চলুন তাহলে আর কথা না বাড়িয়ে দেখে নেয়া যাক রূপচর্চায় দারুচিনি কীভাবে ব্যবহার করা যায়-
(১) ব্রণ এবং ব্রণের দাগ দূর করতে
৩ চা চামচ খাঁটি মধু আর ১ চা চামচ দারুচিনির গুঁড়ো (যেকোন সুপারশপে কিনতে পাবেন/ বাসায় ও আস্ত দারুচিনি বেটে নিতে পারেন) একটি পাত্রে নিয়ে ভালো করে মিক্স করে যে যে স্থানে একনে/ব্রণ হয়েছে সেসব স্থানে ভালোভাবে লাগিয়ে আধা ঘণ্টা রেখে দিন। তারপর কুসুম গরম পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে ফেলুন। ব্রণ এবং ব্রণের দাগ আস্তে আস্তে কমে যাবে।
(২) অ্যান্টি-এইজিং স্কিন মাস্ক তৈরিতে
একটি ডিম আর ২ চা চামচ দারুচিনির গুঁড়ো একটি বাটিতে নিয়ে ভালোভাবে মিক্স করে ফ্রিজে রেখে দিন কমপক্ষে আধা-এক ঘণ্টা। তারপর মাইল্ড ফেসওয়াশ দিয়ে মুখ দিয়ে একটি টিস্যু দিয়ে মুখঘষে চোখের চারপাশের অংশ বাদ দিয়ে আস্তে আস্তে পুরো মুখে চামচের সাহায্যে মাস্কটি লাগিয়ে নিন। দারুচিনির কারণে চামড়ায় সামান্য জ্বলুনি অনুভূত হতে পারে। এক ঘণ্টা পর পানি দিয়ে ভালোভাবে মুখ ধুয়ে ফেলুন। ভালো ফলাফল পেতে প্রতিদিন একবার করে কমপক্ষে দুই সপ্তাহ ব্যবহার করুন। ডিম আপনার স্কিনের পোরগুলোকে ছোট করবে, আর দারুচিনি অ্যান্টি-ব্যাক্টেরিয়াল উপাদান একনে/ব্রণগুলোকে সারিয়ে তুলবে এবং স্কিনকে টাইটেন করবে। এই মাস্কটি একবার বানালে কমপক্ষে তিনদিন ব্যবহার করতে পারবেন।
(৩) পায়ের যত্নে
১ মগ কুসুম গরম পানিতে ২ চা চামচ লেবুর রস, ১ চা চামচ মধু, ২ চা চামচ দারুচিনি গুঁড়ো, ৩-৪ ফোঁটা এক্সট্রা ভার্জিন অলিভ অয়েল মিশিয়ে তাতে পা ভিজিয়ে রাখুন ১৫ মিনিট। পা ধুয়ে ফেলার আগে স্ক্রাব করে নিন ব্রাশ এবং পিউমিস স্টোন দিয়ে। পা দু’টো ঝকঝকে হয়ে যাবে নিমেষেই।
(৪) চুলের যত্নে
৩ চা চামচ এক্সট্রা ভার্জিন কোকোনাট অয়েল, ২ চা চামচ এক্সট্রা ভার্জিন অলিভ অয়েল, ১ চা চামচ ক্যাস্টর অয়েলের (আমি স্কিন ক্যাফে ব্র্যান্ডের অর্গানিক অয়েলগুলো ব্যবহার করি, যমুনা ফিউচার পার্কে অবস্থিত SAPPHIRE এ পাবেন) সাথে ১ চা চামচ দারুচিনির গুঁড়ো মিশিয়ে মাথার চুলসহ পুরো স্ক্যাল্পে লাগিয়ে নিন। ১ ঘণ্টা পর শ্যাম্পু করে নিন। চুল পড়া কমবে, খুশকি দূর হবে, আর ডীপ কন্ডিশনিং তো হবেই।
(৫) ঠোঁটের কালচে ভাব দূর করতে
১ চা চামচ ভ্যাসেলিনের সঙ্গে ১ চিমটি দারুচিনি গুঁড়া মেশান। মিশ্রণটি ঠোঁটে লাগিয়ে রাখুন ১৫ মিনিট। হালকা জ্বলুনি হতে পারে ঠোঁটে। তবে অতিরিক্ত জ্বলুনি হলে সঙ্গে সঙ্গে ধুয়ে ফেলুন। ঠোঁটের কালচে দাগ দূর হবে।
সবাই ভালো থাকবেন, সুস্থ্য থাকবেন, সুন্দর থাকবেন।
ছবি – হোমরেমিডিহ্যাকস ডট কম , রিয়েলফুডমিলস ডট কম
লিখেছেন -ফারহানা প্রীতি