Quantcast
Channel: Shajgoj
Viewing all articles
Browse latest Browse all 3010

বাচ্চাদের জন্যে পরীক্ষার নাম্বার কতটা গুরুত্বপূর্ণ ?

$
0
0

স্কুল ছুটির পর ছেলেকে আনতে গিয়েছি । মুখ যতটা সম্ভব কালো করে সে এসে আমার হাত ধরলো। এই মুখ কালোর কারণ আমি জানি তাই কিছু জানতে চাইলাম না। অবশ্য এখন কিছু জানতে চাইলে বলবেও না। তাছাড়া আমারও কিছু জানতে ইচ্ছে হচ্ছে না। গতকাল পর্যন্ত পরপর তিনদিন হলো।  মন মেজাজ এমনিতেই বিগড়ে আছে। আজ আবারও !

মা ছেলে চুপচাপ বাড়ির পথে হাটা ধরলাম। অথচ অন্যদিনগুলোতে বাড়ি ফেরার পথে ছেলে স্কুলের সব কথা একসাথে বলে শেষ করতে চায়। জানতে চাইলাম কতো পেয়েছ? সংক্ষিপ্ত উত্তর এইট পয়েন্ট ফাইভ। মা ছেলে মন খারাপ করে আবার হাটতে শুরু করলাম। নাহ এবার আর প্রথম হওয়া হলো না!

ছয় মাস আগেও ওর বা আমার এমন পরিস্থিতি ছিল না। কত হাসি আনন্দের দিন ছিল। ওর সব কিছুই সব সময় আমার কাছে অসাধারণ। তাহলে এই ছয়মাসে কি এমন হাতিঘোড়া এলো যে মা ছেলের দিন বদলে গেলো?

হাতিঘোড়া না এলেও ওর জীবনে পরীক্ষা এসেছে। এবং আমাকে অবাক করে দিয়ে , আমার কোন প্রচেষ্টা ছাড়াই ওর জীবনে প্রথমবারের মতো পরীক্ষা দিয়ে ফাইনালে  তিন শ্রেণী মিলে সে প্রথম হয়ে গেল। ব্যস শুরু হয়ে গেল আমার ভালো ছাত্র ছেলের ভালো রেজাল্ট রক্ষার চিন্তা। আর স্কুল্টাও এতই পচা প্রায় প্রতিদিনই ক্লাস টেস্ট , সারপ্রাইজ টেস্ট লেগেই আছে।  

যেদিন 10/10 পায় সেইদিন মা ছেলের ঈদের দিন। আহারে কি আনন্দ! আর যেদিন 9.5/10 সেদিন হয় আজকের মতো অমাবস্যা অবস্থা।

যদিও আমি গর্ব করে বলি  কম নম্বর পাওয়ায় ছেলেকে কখনো বকাঝকা বা মারধোর করিনি।  কিন্তু সত্যি কথা হলো কম নম্বর পেলে খুব স্বাভাবিক আচরণ ও করতে পারি না। কেমন যেন চুপসে যাই। সবই করি, সবই বলি কিন্তু ছেলে ঠিকই বুঝতে পারে সে মাকে খুশি করতে পারেনি। আর তাই হয়তো যেদিন নম্বর কম পায় সেদিনই ছেলে ছুটির পর মুখ কালো করে বের হয়।

এসব ভাবতে ভাবতে পথ চলছিলাম হঠাৎ তাকিয়ে দেখি ছেলে আমার চেয়ে অনেকটা পথ এগিয়ে গিয়ে এখন বড় রাস্তার মাথায়। এখন যদি বেখেয়ালে মায়ের অপেক্ষা  না করেই রাস্তা পার হতে চায় …..

মাত্র কয়েকমুহুর্ত , কিন্তু আমার মনে হচ্ছিলো অনন্তকাল ধরে আমি ছেলের দিকে পৃথিবীর সব ভুলে দৌড়াচ্ছি……. ছেলেকে যখন জড়িয়ে ধরে থামলাম সমস্ত পৃথিবী তখন আমার হাতের  মুঠোয়। প্রচন্ডভাবে আমার হুশ হলো। পরীক্ষা , পরীক্ষার নম্বর সব ততক্ষণে তুচ্ছাতি তুচ্ছ। অতি তুচ্ছ …….

সেই থেকে পরীক্ষার নম্বর আমাদের মা ছেলের মধ্যে আসতে পারে না। আমি যতটুকু পারি পড়িয়ে দেই কত নম্বর পাবে সেটা তার ব্যাপার। আমার চেস্টা তার সুস্থতা আর মনুষ্যত্ব। বাকিটা তার নিজের। এখন আর সে খারাপ নম্বর পেলে মায়ের মন খারাপ এর ভয়ে মুখ কালো করে বের হয় নাl মুখ যদি কালো হয় সেটা তার নিজের অপ্রাপ্তিতে। তার মায়ের প্রাপ্তির জায়গা অন্যখানে ছেলে সেটা বুঝতে পেড়েছে খুব ভালোভাবে।

একটা ক্লাসে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃত্বীয় হবে মাত্র তিনজন। বাকিরা হবে না এটাই বাস্তবতা। কিন্তু আমাদের মায়েদের কারণে ক্লাসের ৪০ জন ছেলেমেয়ের সবাই ওই তিনজন হওয়ার চাপে থাকে নিজেদের ইচ্ছা অথবা অনিচ্ছায়। আমরা আমাদের চারপাশে একবার চোখ ভুলালেই  দেখবো জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে স্কুল পরীক্ষায় প্রথম/দ্বিতীয় হওয়া  খুব বেশি প্রয়োজন নেই। এর চেয়ে অনেক বেশি দরকার শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা । যে সন্তানের সামান্য সর্দিকাশিতে আমরা মা বাবা অস্থির হয়ে থাকি পরীক্ষায় কম নম্বর পাওয়াতে সেই একই মা-বাবা  তাকে মানসিকভাবে কষ্টে রাখাটাকে নিজেদের দায়িত্ব মনে করি। কেউ কেউ তো আরেক ধাপ এগিয়ে মারধর করাটাকে অবশ্য কর্তব্য মনে করি।

এটা অন্যায়। বিরাট অন্যায়। সন্তানের প্রতি অন্যায় এমন কি নিজের প্রতিও। নিজের সন্তানের সাথে হাসি আনন্দে কাটানোর মতো অনেক ব্যাপার ঘটে। শুধুমাত্র পরীক্ষায় কম নম্বর পাওয়ার কারণে মুহূর্তের জন্যও সেসব থেকে নিজেদের বঞ্চিত করা ঠিক না । কিন্তু আমরা করি, নিজের অজান্তেই করি। স্কুল ফেরত সন্তানকে জড়িয়ে ধরে যখন বলার কথা “কেমন আছো ?/ ইস কতক্ষণ পর তোমাকে দেখলাম!” আমরা তার ধরে কাছেও না গিয়ে জানতে চাই “আজ কি কি ক্লাস টেস্ট হলো / কোনটাতে কত পেয়েছ ?”ভালো নম্বর পেলে বাচ্চার গর্বিত উত্তর, খারাপ করলে অপরাধী উত্তর।

হ্যা, ভালো নম্বর পেলে আনন্দিত হওয়া যায় তবে এতটা না যেন সন্তানভাবে এটাই মা বাবাকে খুশি রাখার একমাত্র উপায়। আর খারাপ করলে এমন আচরণ করা উচিত নয় যাতে বাচ্চাটি নিজেকে অপরাধী ভাবে।

কিন্তু আমরা প্রথমেই তাকে কাঠগড়ায় দাড় করিয়ে জানতে চাই কেন নম্বর কম পেলে ? কখনো আরেক কাঠি বাড়িয়ে বলি অমুকে কীভাবে ভালো করলো! আমরা একবারও চিন্তা করি না এই সামান্য প্রশ্ন দুইটা ওকে আমার কাছে অপরাধী বানালো এবং অমুক নামে ভালো নম্বর পাওয়া জনের কাছে ওকে সারা জীবনের জন্য ছোট বানিয়ে ফেলল ।

অথচ বাচ্চাদের নখ কাটতে গিয়ে সামান্য বেশি কেটে ফেললেই আমরা মায়েরা পারি না কান্না করে দেই আবার নিজের অজান্তে সেই মায়েরাই ছেলেমেয়ের মনের ভেতরে কতোটা রক্তক্ষরণ ঘটাই।

রক্তক্ষরণ ঘটানোর প্রধান কারণ আমরা  মায়েরা  সন্তানের রেজাল্ট নিয়ে নিজেদের অজান্তেই অহংকার করার প্রবণতায় অথবা আত্মতৃপ্তিতে ভোগার  প্রতিযোগিতায় লিপ্ত থাকি। এটা আমরা স্বীকার করি না কারণ আমরা নিজেরা এটা উপলব্ধি করি না।

কিন্তু কখন কি নিজেকে প্রশ্ন করে দেখেছি, এই সামান্য নম্বর কম পাওয়াতে ওর বা ওর পরিবারের অথবা সমাজের কি ক্ষতি হয়েছে? আর মা হিসেবে আমি যে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছি তাতে ওর বা পরিবারের বা সমাজের কতটা ক্ষতি হচ্ছে ?

আসুন প্রতিক্রিয়া দেখানোর আগে এই সামান্য প্রশ্নটা নিজেকে করি। তাহলে দেখবেন পরীক্ষার সময়ে  ওর করা পরিশ্রমটাকে আমরা মূল্যায়ণ করতে জানবো এবং অনেক বঞ্চিত ভালবাসা দুইজনেই ফিরে পাবো । ওর প্রতি আমাদের মূল্যায়ণ দেখে সে নিজের মূল্য উপলব্দি করতে শিখবে ।

এটা  একদিনে হবে না । খুব ধীরে ধীরে নিজেকে এবং সন্তানকে প্রস্তূত করতে হবে ।

 তার কাজের দায়িত্ব তার উপর ছেড়ে দিন।

 ওর ভালোটা খুঁজে বের করুন এবং পরিচর্যা করুন।

 অমুক তমুকের সাথে তুলনা করা ছাড়ুন।

 ওর নিজের আত্ববিশ্বাস বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করুন।

নিজেদের জীবনে নিয়মানুবর্তিতা বজায় রাখুন সন্তানকে সেই জীবনে অভ্যস্ত করার চেষ্টা করুন।

নম্বর সংক্রান্ত কারণে সন্তানের উপর রাগ উঠলে তার যেকোন অসুস্থতার স্মৃতি মনে করুন রাগ দৌড়ে পালাবে। অথবা তার সাথে হাসি আনন্দের সময়গুলো নিয়ে ভাবুন।

 ছবি – ইয়াসির আরাফাত

লিখেছেন – ইয়াসমিন আখতার মনি   


Viewing all articles
Browse latest Browse all 3010

Trending Articles